জ্বল জ্বল করতে থাকে নিটোল অক্ষর৷ হস্তাক্ষর৷ তার ওপর গিয়ে পড়ে কবির চোখ৷ চিকচিক করে ওঠে সেই চোখ৷ আর ওই চোখের দু্যতিতে লেখা হয়ে যায় আনন্দ ও আগ্রহ৷ কার চোখ? কার হস্তাক্ষর? আমি এখানে বুদ্ধদেব বসুর চোখ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তাক্ষরের কথা বলছি৷ পুত্র যেন শিশুর চিঠিতে চোখ রেখেছে৷ পিতার অক্ষর আর পুত্রের চোখ একই জায়গায় এসে মিলেছে৷ তখন ১৯৩৫ সাল৷ বুদ্ধদেব প্রকাশ করেছেন সেই বিখ্যাত কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যা, যে পত্রিকাটি ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছাবি্বশ বছর ধরে নির্মাণ করে গেছে, সেই কাব্য সংস্কৃতি যাকে আমরা আধুনিকতাবাদী বলে থাকি৷ পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধদেব একটি কপি পাঠিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের কাছে৷ তিনি দ্রুত পড়ে ফেলেন পত্রিকাটি৷ একটা চিঠিও পাঠান বুদ্ধ দেবকে৷ চিঠিটার মূল সুরের একটা সংক্ষিপ্ত চরিত্রায়ন এভাবে দাঁড় করানো যায় : সাবাশ, পুত্র! পিতার চিঠি পেয়ে পুত্র অবশ্যই আনন্দিত হয়৷ মাঝে মাঝে এমনকি নিজেকে বৈধ করার জন্য বা নিজের কথা বলার জন্যই অবাধ্য বা বিদ্রোহী পুত্ররাও পুরুষতন্ত্রের পেশি ফুলিয়ে পিতাকে নিয়ে অহংকার করে থাকে৷ বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একাধিকবার অহংকার করেছেন; আবার রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতাও করেছেন৷ কিন্তু ওই চিঠি প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের দৃষ্টি কেড়েছে রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষর৷ বুদ্ধদের তার প্রতিক্রিয়া জানান দেন এভাবে : ‘মস্তএকখানা তুলোট কাগজের এপিট-ওপিঠ ভর্তি সেই অনিন্দ্য সুন্দর হস্তাক্ষর, যার তুলনা আমি দেখেছিলাম বহুকাল পরে অক্সফোর্ড এবং প্রদর্শনীতে টেনিসন ও রবার্ট ব্রিজেস-এর পাণ্ডুলিপিতে৷’
তার হস্তাক্ষর-মুগ্ধতার বয়ান উপস্থিত করার জন্য বুদ্ধদেবকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অক্সফোর্ডের ওই প্রদর্শনীর জন্য, যেখানে তিনি আবিষ্কার করেন এমন এক তুলনা যার অভিমুখ পশ্চিম_ সেখানে থাকেন টেনিসন ও ব্রিজেস-এর মতো ইংল্যান্ড-মুগ্ধ ইংরেজ কবিরা৷ বুদ্ধদেব বসু নিজেই প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানভাবেই তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার চর্চা করেছেন৷ তুলনা করা তার অভ্যাস বটে৷ মাঝে মাঝে তিনি হুটহাট করে এর সঙ্গে ওর তুলনাও করেন৷ তুলনামূলক সাহিত্যে বেশ সময় ধরে প্রশিক্ষিত হওয়ার সুবাদে আমি নিজেই টের পেয়ে যাই যে, গ্যেটের পথ ধরে এগুনো তুলনামূলক সাহিত্য চেহারায় ও চরিত্রে ইউরোপকেন্দ্রিক আর বুদ্ধদেব বসুরা তুলনামূলক সাহিত্যের যে ধারা তৈরি করেছিলেন তা প্রায় সর্বাংশেই পশ্চিমাকেন্দ্রিক, যে কেন্দ্রিকতার পেছনে কাজ করেছে এক ভুয়ো ‘আন্তর্জাতিকতাবাদ-এর দোহাই আর যে-আন্তর্জাতিকতাবাদ স্বভাবতই উপনিবেশবাদের যুগে জাতীয় সংস্কৃতির নির্মাণের প্রয়োজনীয়তাকে প্রায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে৷ চামড়ার রঙ বাদামি, কিন্তু সাদা মুখোশ পরা চাই’_ এমনি এক তাগিদই তো রবীন্দ্রনাথকে হুট করে টেনিসনের আর ব্রিজেসের কাতারে আনতে চায়৷ এতে রবীন্দ্রনাথ জাতে ওঠে? নাকি এর নাম বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব? নাকি এর নাম আত্মনিরাপত্তাহীনতা? আর বিশ্ব মানেই কি পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র অংশ যার নাম ইউরোপ? প্রশ্নগুলোতে আমরা পরে ফিরে যাব৷ কিন্তু তার আগে এখানে এও বলে নেয়া প্রয়োজন যে, তুলনামূলক সাহিত্যের এলাকা নিঃসন্দেহে বুদ্ধদেব বসুর কাজের সমগ্রের একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র এবং এই অংশের নিরিখে বুদ্ধদেবের সামগ্রিক মূল্যায়নও আমার উদ্দেশ্য নয় মোটেই৷ ওকে লালন ফকিরের গান থেকে বের করে আনা একটা ইঙ্গিতও মনে ধরে : কোন তুচ্ছ অংশেও সমগ্রের ইশারা বা আভাস পাওয়া যেতে পারে৷ হুট করে মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া কোন খণ্ড উচ্চারণ কিংবা কোন ছোট বা ছেঁড়া চিরকুটে লেখা মন্তব্য কিংবা কারও সম্পর্কে কোন তাত্ক্ষণিক ধারণাও এমন কিছু বয়ান বা জ্ঞানভাষ্য তৈরি করতে পারে, সেখানে একজন লেখকের মনোগঠনের আকিবুকি খানিকটা পড়া যেতে পারে৷ এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই আমি বর্তমান রচনায় বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনামূলক কাজের কয়েকটি দিক নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা হাজির করতে চাই৷
২.
আমার নির্দিষ্ট কিছু জিজ্ঞাসাসহ কয়েকটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ হাজির করার আগে বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যিক ও নানন্দনিক তত্পরতা এবং অবদান নিয়ে কিছু কথা বলে নিতে চাই৷ প্রথমত, বুদ্ধদেব বসু যথার্থই একজন সব্যসাচী লেখক৷ বলা যাবে, সব্যসাচী লেখক হয়ে ওঠার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন আজীবন৷ পিতার অনুকরণেই কিন্তু পিতার সঙ্গে পালা দিয়েই যেন এগিয়ে যেতে চেয়েছে৷ আমি পিতা বলতে রবীন্দ্রনাথকে বোঝাচ্ছি; পুত্র তো বুদ্ধদেব বসু নিজেই৷ পিতা-পুত্রের টানাপড়েন, সংঘর্ষ ও ঐক্যের প্রসঙ্গগুলোকে নিদেন পক্ষে রূপকার্থে চালু করার ভেতর দিয়ে আমি অবশ্য বুদ্ধদেবের অপরীক্ষিত আধুনিকতাবাদের পুরুষতান্ত্রিক চেহারাটাও খানিকটা দেখে নেয়ার চেষ্টা করছি৷ কিন্তু না, বিস্তারের দিক থেকে পুত্র পিতাকে টপকাতে পারেনি৷ তারপরও বুদ্ধদেবের সাহিত্যিক বিস্তারের কথা বেশ জোরেশোরে বলতে হয় : কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটকও লিখেছেন, সমালোচনাও হাজির করেছেন, নিবন্ধ লিখেছেন, চিঠিও লিখেছেন প্রচুর, রম্যরচনাও পাওয়া গেছে তার কাছ থেকে৷ এছাড়া তো রয়েছে বিদেশী সাহিত্য, বিশেষ করে ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে তার সাড়া জাগানো প্রভাবশালী অনুবাদ৷ সংস্কৃত সাহিত্য থেকেও অনুবাদ করেছেন তিনি; বিশেষভাবে উলেখ করা যাবে কালিদাসের মেঘদূত-এর কথা৷ তুলনামূলক সাহিত্যের এলাকাতেও তার কাজ আছে, যে কথা আগেই বলেছি৷ আমার এই সংক্ষিপ্ত বয়ানেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, বুদ্ধদেব একজন সব্যসাচী লেখক৷ এও বলা দরকার, কেবল ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যেই বুদ্ধদেব লিখেছেন নিদেনপক্ষে ৮৫টি বই এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে বেরিয়েছে আরও ৬৫টি বই৷ ১৯৭৪ সালে তার মৃতু্যর পর প্রকাশিত বইগুলো না হয় বাদই দিলাম৷ যেমন তিনি বহুপ্রজ লেখকও বটে৷
কিন্তু সব্যসাচী ও বহুপ্রজ লেখক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর তত্পরতার কথা বলাটাই যথেষ্ট নয়৷ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যা ভীষণভাবে তাত্পর্যপূর্ণ হয়েছে, সে বিষয়টিও সামনে আনতে হয়৷ তা হচ্ছে বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবশালী সাহিত্যিক-সাংগঠনিক তত্পরতা যার অনুপস্থিতিতে বোধ করি বাংলা কবিতার চেহারা ও চরিত্র অন্যরকম হতে পারত৷ হঁ্যা, বিশেষ দশকে ঢাকা থেকেই শুরু হয়েছে তার সাংগঠনিক তত্পরতা৷ এই তত্পরতার আবার তিটি মাত্রা অনায়াসেই শনাক্ত করা যায় : সম্পাদনা, সমালোচনা ও প্রকাশনা৷ ঢাকায় থাকাকালীন বুদ্ধদেব বসু সম্পাদনা করেন দুটি পত্রিকা : ১৯২২ সালে প্রকাশিত জগন্নাথ হলের বার্ষিকী বাসন্তিকা এবং ১৯২৭ সালে কবি অজিত দত্তের সঙ্গে তার যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা প্রগতি৷ এরপর কলকাতায় ১৯৩৫ সাল থেকে শুরু হয় বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত ত্রৈমাসিক কবিতার ভীষণ প্রভাবশালী সাহিত্যিক বাঁক চিহ্নিত অভিযাত্রা, যার সমান্তরাল বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসেই অনুপস্থিত৷ ফরাসি তাত্তি্বক পিয়ের বুরদো যাকে বলেছিলেন ‘বিপণনের প্রতীকী লজিক, যা নিমিষেই নান্দনিকতার ঝলমলে পোশাক পরে নিতে পারে, তাই যেন ঠিকঠাক বুঝে গিয়েছিলেন কবিতা পত্রিকার ওই সম্পাদক, যিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এই কথাটা : লেখাটাই যথেষ্ট নয়; দরকার তার বৈধতা ও ক্ষমতা৷ এক অর্থে আধুনিকতাবাদকে বৈধ ও ক্ষমতাশালী করার ক্ষেত্রে কবিতা পত্রিকাটির ঐতিহাসিকভাবে তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ ওই কবিতা পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় যারা বুদ্ধদেব বসুকে সহায়তা করেছেন, তারা হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, নরেশ গুহ, প্রতিভা বসু এবং এমনকি কবি সমর সেন৷ ওই কবিতা পত্রিকা ছাড়াও ১৯৩৮ সালে বুদ্ধদেব বসু আবার হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে যৌথভাবে বের করেন চতুরঙ্গ নামের একটি পত্রিকা৷ পরে অবশ্য বুদ্ধদেব বসু ওই পত্রিকা থেকে সরে আসেন৷
এবার কবিতা পত্রিকা নিয়ে দু’একটা কথা বলা যাক৷ এই পত্রিকার ভেতর দিয়েই বুদ্ধদেব বসু বিভিন্ন সৃজনশীল লেখকের শুধু তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিকে আরও তৃষ্ণার্তই করেননি; তিনি এক ধরনের মতাদর্শিক আধিপত্যও তৈরি করেছিলেন বটে৷ এই পত্রিকার পাতাতেই বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য নিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েই সমালোচনা করেছেন; যেমন তিনি লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবতর্ী প্রমুখ সমকালীন কবিদের নিয়েও৷ তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী কবি হিসেবেও যাদের চিহ্নত করা হয়, যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত, নিশিকান্তপ্রমুখ, তাদের নিয়েও লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু৷ যতীন্দ্রনাথ ও নজরুল তো রয়েছেনই৷ এমনকি ‘বামপন্থী’ কবি হিসেবে পরিচিত সুভাষ মুখাপাধ্যায় ও সমর সেন নিয়েও লিখেছেন তিনি, যেমন লিখেছেন তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও৷ এভাবে কবিতা প্রকাশ করার পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসু নিজেই সাহিত্য সমালোচনার একটি চেহারা ও চরিত্র দাঁড় করিয়েছেন৷
এও লক্ষ্য করা দরকার যে, ১৯৩৫ সালে শুরু হয় কবিতা পত্রিকাটির অভিযাত্রা৷ ওই একই সালে ইউরোপের সাহিত্যেও বেশ চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়, কেননা ওই সালেই বের হয় ইয়েটসের বিখ্যাত এ ফুল মুন ইন মার্চ, এলিয়টের নাটক মার্ডার ইন ক্যাথিড্রেল, মার্কিন আধুনিকতাবাদী দুই কবি ওয়ালেস স্টিভেন্স এবং উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে আইডিয়াস অব অর্ডার এবং অ্যান আলি মারটার অ্যান্ড আদার পোয়েমস৷ এছাড়া দু’জন গ্রিক কবি কনস্তানতিন কাভাফি ও গিয়োগোর্স সেফেরিস-এর কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে টেল অব লেজেন্ডস এবং পোয়েমস অব সিংপি কাভাফি প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালেই৷ আরও যুক্ত হয় মার্কিন নিরীক্ষাধমর্ী নকশা-মকশো করা, ক্রীড়াপ্রবণ, লিরিক কবি ই. ই. কামিংস-এর নো থ্যাঙ্কস৷ এখানে এও উলেখ করা দরকার যে, ১৯৩৩ সালে স্পেন ঘুরে এসে স্পেন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ১৯৩৫ সালে কবি আলামা ইকবাল বের করেন তার কাব্যগ্রন্থ বাল-ই-জিব্রিল; আর অন্যদিকে স্পেনের কবি লোরকা ওই একই সালে প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত সিক্স গ্যালিশিয়ান পোয়েমস৷ এভাবে ১৯৩৫ সাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে৷
কিন্তু কবিতা পত্রিকার ভেতর দিয়ে কী ধরনের সাহিত্য-সমালোচনা দাঁড় করালেন বুদ্ধদেব বসু? প্রথমত বলে নেয়া দরকার যে, একজন কবির বা কথাসাহিত্যিকের ক্ষমতা ও খানিকটা কারিগরি দক্ষতাকে দ্রুত শনাক্ত করতে পারতেন বুদ্ধদেব বসু; এর প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যাবে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার সমালোচনার কাজকে যেমন, তেমনি নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবতর্ী ও বিদেশীদের মধ্যে বিশেষ করে বোদলেয়রকে নিয়ে তার কাজকেও সামনে আনা যাবে, যদিও নজরুল ও বোদলেয়রের স্বভাব ও চিহারাকে একাধিক পরিসরে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন বুদ্ধদেব বসু৷ এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘প্রচুর লেখা উপহার দেয়া সত্ত্বেও তিনি পুতুপুতু রাবিন্দ্রকতাকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, প্রায় ততটাই তিনি এড়িয়ে গেছেন সেই রবীন্দ্রনাথকে যিনি ইতিহাসে মানুষের স্থান, ঐতিহাসিকতার সঙ্গে সামাজিকতার সম্পর্ক, পুবের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক, শিক্ষার অর্থ ও স্বরূপ, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এক ধরনের চিন্তার লিপ্ততার প্রমাণ রেখেছেন৷ এসব প্রসঙ্গে পরে ফেরা যাবে৷ তবে বুদ্ধদেবীয় সমালোচনার ধরন নিয়ে দু-একটা পর্যবেক্ষণ হাজির করা যাক৷
হঁ্যা, কোন একজন লেখককে নিয়ে যখন বুদ্ধদেব বসু আলোচনা করেন, তখন একজন লেখকের কাজকে যতটা তিনি ভাষিক ঘটনা হিসেবে দেখেন, ততটা তিনি তাকে জাগতিক ঘটনা হিসেবে দেখেন না৷ এতে মনে হয় যে, ভাষা যেন উড়াল দিয়ে বইয়ের পাতার হরফে হাজির হয়েছে৷ জগতের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে কিংবা ভাষার জাগতিকতা ও জগতের ভাষিকতা নিয়ে, মাথা ঘামাবার সময় ছিল না বুদ্ধদেব বসুর৷ কিন্তু আবার ভাষিক ঘটনা হিসেবে একটি সাহিত্যিক কাজকে যখন তিনি বিবেচনায় রাখেন, তখন আবার ভাষার ঘনিষ্ঠ পঠনের দিকেও যে তিনি অগ্রসর হয়েছেন তা বলা যাবে না৷ বরঞ্চ একটি কাজ নিয়ে বা তার ভাষা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু তার অনুভব ও অভিজ্ঞতাকে প্রশয় দিয়েছেন এবং তাদের পক্ষে উদাহরণও জড়ো করেছেন৷ আবার সাহিত্যের বা ভাষার ইতিহাসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাঠ করার ভেতর দিয়ে কোন একটি সৃজনশীল কাজের স্বরূপ উদঘাটনেও বুদ্ধদেবের আগ্রহ প্রায় শূন্য ছিল বলেই চলে৷ অন্য কথায়, বুদ্ধদেব ইঙ্গ-মার্কিন ‘নিউ ক্রিটিসিজম্-এর সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাস-বিমুখতাকে সঙ্গে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার বিশেষণী পদ্ধতিকে নয়৷ আবার কোন গভীর সংশেষণের দিকে যে তিনি অগ্রসর হয়েছেন, তাও বলা যাবে না৷ তিনি বিশেষণীও নন, সংশেষণীও নন৷ বরঞ্চ তিনি খানিকটা যুক্তির চালেই নির্ভর করেছেন ‘ইমপ্রেশান’-এর ওপর৷ তার সমালোচনামূলক কাজে ওই ‘ইমপ্রেশান’-এর বিস্তারই লক্ষ্য করা যায়, যদিও তিনি থেকে থেকে নিজের মতো করেই উদাহরণ জড়ো করতে ভুলেন না৷ এভাবে এও ধরা পড়ে যে, পশ্চিমা মুলুকের ‘বেল-লেত্রিস্ত্’ ঐতিহ্যের একটা বড় আছর পড়েছিল বুদ্ধদেব বসুর ওপর৷ অর্থাত্ পাশ্চাত্যমুখী বুদ্ধদেব বসু পাশ্চাত্যের ‘নিউ ক্রিটিসিজম্’-এর সঙ্গে পুরোপুরি তাল মিলাতে সক্ষম না হলেও তার খানিকটা অাঁকড়ে ধরে ওই ‘নিউ ক্রিটিসিজম্-এরও আগের যুগে ফিরে যেতে চেয়েছেন৷
আর এভাবেই বুদ্ধদেব বসু তার গদ্যও তৈরি করেছিলেন_ এমন এক গদ্য যা নিঃসন্দেহে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্য দারুণভাবে পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছে, যে-গদ্য তরতর করে বয়ে চলে, যাকে আবার কেউ কেউ ‘মিষ্টি গদ্যও’ বলেছেন বটে৷ তার রম্যরচনার গদ্যের সঙ্গে আসলেই তার সমালোচনার গদ্যের তেমন পার্থক্য চোখে পাড়ে না৷ সত্য, এই গদ্য দিয়ে একাধিক কাজ করা সম্ভব বটে৷ তা করেছেনও বুদ্ধদেব বসু৷ কিন্তু এ-গদ্যে চিন্তার প্রাখর্য্য কিংবা বিশেষণের তীব্রতা বা প্রশ্নের রাজনৈতিকতা জমে উঠে না৷ সেগুলো অবশ্য বুদ্ধদেবের অভীষ্ট ছিল না৷ কিন্তু তিনি যা করেছেন তাতে আমরা আয়েশি গদ্যফাঁদা এমন একজন সমালোচককে পাই, যিনি আমাদের চিন্তাকে ঘুম পাড়াতেই ব্যস্ত, জাগাতে নয়৷ সমালোচনার ইহজাগতিক উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রশ্ন তোলার ভেতর দিয়ে কিংবা অপরীক্ষিত বা উপেক্ষিত অঞ্চলকে দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে বিরাজমান ব্যবস্থা বা ক্ষমতা-সম্পর্ককে ধাক্কা দেয়া বা তাকে এমনকি ভেঙে ফেলা৷ আবার সমালোচনা বলতে কেবল মূল্যায়ন বা বিশেষণকেই বোঝায় না; সমালোচনা হচ্ছে চিন্তাশীল সাংস্কৃতিক অনুশীলন যা বিরাজমান অসম ক্ষমতা সম্পর্কের কাঠামোর সঙ্গে বিভিন্নভাবেই বিরোধে জড়িয়ে থাকে৷ বলা বাহুল্য, ‘বেল-লেত্রিস্ত’ ঐতিহ্যের অনুসরণেই এবং নান্দনিকতার এক বিশেষ মতাদর্শিক টানেই বুদ্ধদেব বসু সমালোচনাকে প্রকৃত অর্থে বাংলার উপনিবেশপীড়িত জীবনের ছন্দঃস্পন্দে জারিত করে তাকে চিন্তার ঘাম-ঝরানোর এবং রক্তপাতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি৷ সত্য সাহিত্যের বিভিন্ন এলাকায় ও মাধ্যমে তিনি প্রায় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, যে-কথাটা আগেই বলেছি৷ কবিতা ও সমালোচনা ছাড়া তিনি লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনী ও শিশুকিশোর সাহিত্য৷ এসব সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসু সমালোচনার এলাকায় এসে বেশ সীমিত হয়ে পড়েন৷ কারণ জীবন মানেই কেবল নান্দনিকতা, ভাষিকতা ও ব্যক্তিকতা নয়৷
বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনামূলক কাজ নিয়ে আরও কয়েকটি কথা বলে নেয়া দরকার৷ এখানে তাহলে নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর সেই বিখ্যাত আলোচনার প্রসঙ্গটাই চলে আসে৷ অস্বীকার করার জো নেই যে, বেশ গুরুত্বসহকারেই নজরুলের কবিতাকে সামনে এনেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, চিহ্নিত করছিলেন নজরুলের কাব্যশক্তি৷ বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পর সবচেয়ে যে বড় কবিত্বশক্তি নজরুল ইসলামের৷’ তবে বুদ্ধদেব বসুকে জুড়ে দিতে হল ওই সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথাও৷ এবং তার তর্জনী-নির্দেশে একধরনের হায়ারার্কিও নির্দিষ্ট হল৷ কিন্তু কেন এই হায়ারার্কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতেও রাজি নন বুদ্ধদেব বসু৷ এরপর বুদ্ধদেব বসু নজরুলের কবিতায় ‘হৈ চৈ’-কে অনান্দনিক ঠাওরিয়ে নজরুলের গদ্যে তার ‘অতিমুখর মনের অসংযত বিশৃঙ্খলা’ চিহ্নিত করে শরণাপন্ন হন ইংরেজ ‘রোমান্টিক’ কবি বায়রনের৷ হুট করেই যেন নজরুলের সঙ্গে বায়রনের তুলনা করে বসেন বুদ্ধদেব বসু৷ তিনি মোটেই বিবেচনায় রাখেন না যে, বায়রন একজন রেজ অভিজাত, বিদ্রূপপ্রবণ, সনাতন-সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া কবি আর অন্যদিকে নজরুল একেবারে গ্রামীণ প্রোলেতারিয়েত থেকে উঠে আসা একজন বিদ্রোহী কবি; যার গায়ে লেগে থাকে বাংলার মাটি-কাদা-জলের চিহ্ন ও গন্ধ, যা থেকে অবশ্য বুদ্ধদেব বসু সরিয়ে রাখেন তার নান্দনিক ইন্দ্রিয়৷ কিন্তু বায়রনের সঙ্গে নজরুলের তুলনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেন না বুদ্ধদেব বসু৷ গ্যেটের রবাত দিয়ে আবার এও বোঝান যে, চিন্তা করতে গিয়ে নজরুলের অবস্থা হয় একজন শিশুর মতো৷ (যেমন গ্যেটের বিবেচনায় ওই একই অবস্থা হয় বায়রনেরও)৷ এখানে বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব তুলনামূলক চিন্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে বটে৷ তবে তুলনার জন্য বা নান্দনিক উত্কর্ষের মাপকাঠির জন্য পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিষ্ঠানিকভাবেও উদযাপিত লেখকদের দ্বারস্থ হওয়াটা বুদ্ধদেব বসুর পক্ষে স্বাভাবিকই বটে, কেননা যে-বিদেশী সাহিত্যে ও সাহিত্য সমালোচনায় বুদ্ধদেব বসু প্রশ্নহীনভাবে বিচরণ করেছেন সেগুলো ছিল তুমুলভাবে ইউরোপকেন্দ্রিক৷ আর ‘শিশু’ বলতে বুদ্ধদেব বসু কি বুঝিয়েছেন তার কোন ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না তার কাছ থেকে৷ অন্যদিকে আবার পরিপক্বতা বা ‘প্রগতি’ আসলেই কী বস্তু তার ওপর কোন আলো ফেলেন না তিনি৷ তাহলে কি অন্তত ধরে নেব যে, পরিপক্বতা কিংবা সাবালকত্ব মানে ‘হৈ চৈ’ না করা? বা তার মানে কি বুদ্ধদেব বসুর মতো পশ্চিমা উপনিবেশবাদ নিয়ে কোন প্রশ্ন না তুলে বরঞ্চ লেপের নিচে বৃষ্টির রাতে আরাম করে পড়া যায় এমন এক মিষ্টি গদ্যে বা কবিতায় অনুভব ও অভিজ্ঞতাকে বাজিয়ে নেয়া৷
নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনায় এও লক্ষ্য না করে উপায় নেই যে, তিনি নজরুলের চরিত্রায়নে ‘শিশু’ দিয়ে শুরু করে ‘বালক’-এ উপস্থিত হয়েছেন৷ নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর সেই পুরনো উক্তিটাকে সামনে আনতে বাধ্য হচ্ছি৷ বুদ্ধদেব বলছেন, ‘পঁচিশ বছর ধরে প্রতিভাবান বালকের মতো লিখেছেন তিনি, কখনো বাড়েননি, বয়স্ক হননি, পর পর তার বইগুলোতে কোনো পরিণতির ইতিহাস পাওয়া যায় না, কুড়ি বছরের লেখা তার চলিশ বছরের লেখা একই রকম৷’ একেবারেই একই রকম? আঙ্গিক থেকে বিষয়বস্তু পর্যন্তসবই একই রকম? বিদ্রোহী কবিতার চেহারা ও চরিত্রের সঙ্গে তার বিভিন্ন ধরনের কবিতার চেহারাকে এক করে দেখা যায়? ‘বাড়েনি’ কথাটিরই বা অর্থ কী? এসব প্রশ্ন আজও প্রশ্ন থেকে যায়, কেননা প্রশ্নগুলোর কোনো মীমাংসা নেই বুদ্ধদেবের ওই আপাত আগ্রহতাড়িত আলোচনায়৷ এও লক্ষ্য করা দরকার যে, নজরুলের পুরো কাব্যকর্মের ওপর_ পঁচিশ বছরের কাজের ওপর_ বুদ্ধদেব বসু এক চূড়ান্তফতোয়া জারি করেছেন, যাকে বর্তমান সময়ের নিরিখে আবারও খতিয়ে দেখা দরকার৷ জানি, নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনাকে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনেকেই বাহবা দিয়েছেন৷ এও জানি, নজরুলের প্রতি বুদ্ধদেব বসুর একটা বিশেষ টানও ছিল; নজরুলকে নিয়ে তিনি বিশেষ সংখ্যাও করেছেন বটে৷ কিন্তু ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর নজরুল ইসলাম শীর্ষক সমালোচনামূলক রচনাটি খেয়াল করে বার বার পাঠ করলে ধরা পড়ে, রচনাটি আসলে ‘ব্যজস্তুতির একটি বিশেষ ঐতিহাসিক নমুনা৷ আর এই ‘ব্যজস্তুতি’ হচ্ছে প্রশংসাচ্ছলে নিন্দা৷
আবারও ফেরা যাক বুদ্ধদেব চিহ্নিত নজরুলের ‘হৈ চৈ’ প্রসঙ্গে৷ তার সঙ্গে ‘রুচি’র প্রশ্নেও, যে প্রশ্নটি নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বেশ ভাবিত৷ লক্ষ্য করা যাক বুদ্ধদেব বসুর এই মন্তব্যটি : ‘নজরুল চড়া গলার কবি, তার কাব্যে হৈ চৈ অত্যন্ত বেশি এবং এই কারণেই তিনি লোকপ্রিয়৷ যেখানে তিনি ভালো লিখেছেন, সেখানে তিনি হৈ চৈটাকেই কবিত্বমণ্ডিত করেছেন : তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনায় দেখা যায়, কিপলিঙের মতো, তিনি কোলাহলকে গানে বেঁধেছেন৷’ এই সংক্ষিপ্ত বয়ানটির একটি মনোযোগী পঠনে বেশ কয়েকটি বিষয় বেরিয়ে আসে৷ প্রথমেই প্রশ্ন জাগে : নজরুল কি কেবলই চড়া গলার কবি? এছাড়া গলা চড়ানোর বিষয়টি যে ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্বে সাংস্কৃতিকভাবেই অনিবার্য হয়ে ওঠে, যখন নান্দনিকতার প্রশ্নটিও ঐতিহাসিকতার উত্তাপে গলে যায় রাজনীতিতেই, সেই বিষয়টি বুঝিয়ে বলাটা বুদ্ধদেবের পক্ষে একেবারেই সম্ভব হয়নি৷ এভাবে বিদ্রোহী নজরুলকে তিনি একেবারেই চিনতে পারেননি৷ বুদ্ধদেবের আলোচনায় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে অবশ্য খানিকটা প্রশংসামূলক মন্তব্য পাওয়া যায়৷ কিন্তু ওই কবিতায় নজরুল কি বলতে চাচ্ছেন এবং কেন তার কণ্ঠস্বর সেখানে উচ্চকিত হচ্ছে, সেই সব প্রশ্নকে একেবারেই এড়িয়ে গিয়ে নজরুলের তাত্পর্যকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন বুদ্ধদেব বসু৷ এবার আসা যাক দ্বিতীয় বিষয়টিতে৷ উদ্ধৃত মন্তব্যটি বলে দেয় যে, হৈ চৈ-এর কারণে, বা ‘হৈ চৈ’কে কবিত্বমণ্ডিত না করার কারণে, নজরুলের অধিকাংশ রচনা একদিকে যেমন কাব্যের পর্যায়ে উন্নীত হয় না, অন্যদিকে তেমনি আবার তা লোকপ্রিয় হয়৷ অর্থাত্ বুদ্ধদেবের কাছ থেকে এমনি একটা ইঙ্গিত বেরিয়ে আসে : সর্বসাধারণ হৈ চৈ বোঝে কিন্তু কাব্য বোঝে না৷ হঁ্যা, সত্য, বুদ্ধদেব বসুদের কাব্য আসলেই জনগণের জন্য নয় (কেননা জনগণ ‘অশিক্ষিত’, ‘অনান্দনিক’)৷ তৃতীয়ত, বুদ্ধদেব বসু নজরুলের ‘শ্রেষ্ঠ রচনা’র কথাও বলেন, যেখানে ওই ‘হৈ চৈ’ কবিত্বমণ্ডিত৷ কিন্তু নজরুলের শ্রেষ্ঠ রচনার কথা বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু টেনে আনেন কিপলিঙকে৷ কবি আর পেলেন না বুদ্ধদেব বসু! নজরুলের শ্রেষ্ঠত্বকে বোঝাতে গিয়ে একেবারেই ভিন্ন মতাদর্শের ও স্বভাবের কবি কিপলিঙকে টেনে আনলেন, যে কিপলিঙকে জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পয়গম্বর’, যে কিপলিঙ আবার নিজেই বলেছেন, সাদা মানুষের ‘বার্ডেন’-এর কথা৷ এই কিপরিঙ-এর সঙ্গে নজরুলের তুলনাকে আসলেই হাস্যকর মনে হয়৷ শুধু হাস্যকরই নয়, এই তুলনা মোটেই নিরীহ নয়৷ উদ্ধৃত মন্তব্যসহ বুদ্ধদেব বসুর সমস্তআলোচনাটা বিবেচনায় রাখলে ধরা পড়ে যে, একটি উপনিবেশায়িত মন নিয়েই বুদ্ধদেব বসু নজরুলের মতো একটি তীব্র উপনিবেশবাদবিরোধী কবির পঁচিশ বছরের কাজকে বিচার করতে বসেছেন৷ আর বুদ্ধদেবের মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে গ্যেটে-বায়রন-কিপলিঙ৷
এবার আসি ‘রুচি’ প্রসঙ্গে৷ নজরুলের বিরুদ্ধে তার গানের প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু সরাসরি রুচিহীনতার অভিযোগ তোলেন৷ তবে এও সত্য যে, নজরুলের গানের বেশ প্রশংসা করেছেন বুদ্ধদেব বসু৷ তিনি বলেন, ‘গানের ক্ষেত্রে নজরুল নিজেকে সবচেয়ে সার্থকভাবে দান করেছেন৷ তাঁর সমগ্র রচনাবলির মধ্যে স্থায়িত্বের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তার গানের৷’ কিন্তু এই মন্তব্যের কিছু পরে বুদ্ধদেব বসু এও বলেন, ‘কিছু কিছু রচনা পাওয়া যাবে, যাকে অনিন্দ্য বললে অত্যন্ত বেশি বলা হয় না৷’ আরও বেশি গান যে অনিন্দ্য হয়নি, তার কারণ নজরুলের দুরতিক্রম্য রুচির দোষ৷ কত গান সুন্দর আরম্ভহয়েছে, সুন্দর চলে এসেছে, কিন্তু শেষ স্তবকে কোন একটা অমার্জিত শব্দ প্রয়োগে সমস্তজিনিসটিই গেছে নষ্ট হয়ে৷ ভুরভুর করে বেরিয়ে আসে বুদ্ধদেব বসুর ‘এলিটিজম’৷ আর উদাহরণ ব্যতিরেকে যখন বুদ্ধদেব বসু এই ভাষায় কথা বলতে থাকেন, তখন মনে হয় যে, তিন ‘রুচির’ একচ্ছত্র এজেন্সি নিয়েছেন৷ আর এই ‘রুচি’ বিষয়টি বা কী? কে ঠিক করে দেবে কোনটি রুচিশীল আর কোনটি নয়? ‘অমার্জিত’ শব্দ বলতেই বা কী বোঝায়? এসব প্রশ্ন কেবল আমার নয়৷ প্রশ্নগুলো অন্য পরিসরে তুলেছেন বুদ্ধদেব বসুরই সমসাময়িক ‘তৃতীয় বিশ্বে’-এর একদল কবি৷ বিশেষভাবে উলেখ করা যাবে চিলির কবি পাবলো নেরুদা, ক্যারিবীয় কবি এমে সেজেয়ার আর আফ্রিকি-মার্কিন কবি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর গড়ে ওঠা তৃতীয় বিশ্বের কবি) ল্যাঙস্টন হিউস-এর কথা৷ বলা দরকার, নেরুদা তার ‘পোয়েটিকস অব দ্য ইমপিউর’ নামের এক ইশতেহারধমর্ী রচনায় ভর্ত্সনা করছেন তাদের, যারা কথায় কথায় ‘রুচি’, ‘অমার্জিত’, ‘স্থূল’, ‘অসংস্কৃত’ ইত্যাদি চিহ্নায়কগুলো ব্যবহার করে থাকেন৷ কিন্তু এসব কবির সঙ্গে বোধগম্য কারণেই বুদ্ধদেব বসুর কোনো আত্মীয়তা হয়নি; বরঞ্চ তার আত্মীয়তা স্থাপিত হয়েছে সাদা কবিদের সঙ্গে যাদের বিবেচনার নিরিখে বা মানদণ্ডে বুদ্ধদেব বসু ঠিক করে দেন কোনটি ‘মার্জিত’ আর কোনটি ‘অমার্জিত’, কোনটি ‘কাব্যিক’ আর কোনটি ‘অকাব্যিক’? অবশ্যই বলা যাবে যে, উপনিবেশবাদের সুবাদে আসা তিরিশি আধুনিকতাবাদ যে নান্দনিক উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল জোরেশোরে, সেখানে বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকা থাকে প্রধানই৷
৩.
কিন্তু নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনা প্রসঙ্গে এতটা সময় খরচ করা হল কেন? বুদ্ধদেব বসু আমাদেরকে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা উপহার দিয়েছেন বটে, কিন্তু কেবল নজরুল সংক্রান্তআলোচনা দিয়েই কি বুদ্ধদেবকে বোঝার উপায় আছে? আগেই বলেছি, বুদ্ধদেব বসুর সামগ্রিক মূল্যায়ন আমার এই রচনার উদ্দেশ্য নয়; সেটি বর্তমান রচনার পরিসরে সম্ভবও নয়৷ তবে নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেবের আলোচনাকে গুরুত্ব দেয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে৷ প্রথমত, মতাদর্শিক দিক থেকে নজরুল ইসলাম বুদ্ধদেব বসুর একজন বিশেষ ‘অপর’৷ দ্বিতীয়ত, এই অপরকে দেখার ক্ষেত্রে সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ কার্যকর থাকে, যে চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে একজন আলোচকের ধ্যানধারণা বা চিন্তাভাবনা একটি বিশেষ মতাদর্শিক অবয়ব লাভ করে, যার দিকে তাকিয়ে ওই আলোচকের চেহারা ও চরিত্র খানিকটা চিনে নেয়া যায়৷ তৃতীয়ত, বুদ্ধদেব বসু নজরুল ইসলামকে নিয়ে কথা বলেছেন এমন এক সময় যখন বুদ্ধদেব বসুর একটি নান্দনিক মতাদর্শিক ফ্রেমওয়ার্ক বেশ দাঁড়িয়ে গেছে৷ বিখ্যাত কালো তাত্তি্বক ডবিউ.ই.বি ডুবয়েসের একটা কথা মনে আসে, “একজন শাদা ব্যক্তি যখন আরেক শাদার সঙ্গে কথা বলে, সেখানে তাকে যতটা না চেনা যায়, তার চেয়ে বেশি তাকে চেনা যায় যখন সে তার ‘অপর’ একজন কালো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে৷” ডুবয়েসের উক্তিটা বিবেচনায় রেখেই আমার কাছে বুদ্ধদেব বসুর নজরুলবিষয়ক আলোচনাকে একটি ‘উপসর্গিক’ গঠনের যুত্সই টেক্সট মনে হয়েছে৷
কিন্তু আমি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়েও কিছুটা কথা বলেছি৷ আরও দু’একটা কথা বলা দরকার৷ এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর কবিতার প্রসঙ্গটা হাজির হয়, যদিও বর্তমান রচনার বিষয়বস্তু কবিতার আলোচনা নয় মোটেই৷ তবে বলা যাবে যে, প্রথম কাব্যগ্রন্থ বন্দীর বন্দনা থেকে সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ স্বাগত বিদায় পর্যন্ত যে অভিযাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার টানাপড়েনের বিভিন্ন চিহ্ন পাঠ করা সম্ভব৷ এবং এও বলা সম্ভব যে, তার কবিতায় রবীন্দ্রবিরোধিতা যেমন আছে কিন্তু কবিতায় বুদ্ধদেব বসু যে ‘লিরিক ব্যক্তিকে’ হাজির করেন এবং চালু রাখেন, সেই ‘লিরিক ব্যক্তি’ নজরুলের যেমন অচেনা, রবীন্দ্রনাথেরও তেমনি৷ এই ব্যক্তির বিশেষ ব্যক্তিকতার জন্ম আসলে নগরায়িত ইউরোপের ঔরসেই৷ এই ব্যক্তি ===== আলোড়িত হয়, অযৌক্তিকতায় ভোগে, কার্যকারণ সম্পর্ককে তোয়াক্কা করে না, নগরের ঝকমকে তকতকে পরিসরে ঘুরঘুর করে, বিয়ার খায় (পারলে মার্কিন হ্যামবারগারও), মগজে ঠাসা পাটিগণিতও বোঝে, নির্মল নীল আকাশ কিংবা অসহ্য সুন্দর দেখে, রান্নাঘরের ধোঁয়ায় হাঁসফাঁস করে, শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে বিছানায়ও যেতে চায়৷ এই ব্যক্তি এমনকি দেখে নেয় কিভাবে উজ্জ্বল আঙুর পৃথিবীর মাটিকে মদির করে চুমো খায়৷ এই ব্যক্তি ‘নিজেকেই খেয়ে সে বেঁচে থাকে৷’ এই ব্যক্তি যতটা না প্রেমে পড়ে, তার চেয়ে, ‘প্রেম’ নামের এক ধারণার সঙ্গে সে প্রেম করে৷ কিন্তু তারপরও এই ব্যক্তি ‘স্পর্শের লাল ফুলের উন্মীলন’-এ বিহ্বল হয়ে ভাষার প্রান্তেউপস্থিত হয়৷ এই ব্যক্তি ‘ডিমের মতো রোদ্দুরও’ দেখে৷ এই ব্যক্তি সংরাগ বোঝে, এমনকি রাগও, কিন্তু এই ব্যক্তি যা বোঝে না তা হল তার ঐতিহাসিকতা, যে ঐতিহাসিকতা জনপদ-আচ্ছন্ন করা কাব্যের, গানের, সরের, ভাবের, দুর্যোগের, বিদ্রোহের৷ অবশ্যই বলা যাবে যে, বুদ্ধদেব বসু তার কবিতায় যে ব্যক্তি হাজির করেন, তা একাধারে ইউরোপায়িত, বিচ্ছিন্ন, অনৈতিহাসিক৷ এই ব্যক্তিই কথা বলে উঠে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় এভাবে : ‘শুধু তাই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত৷’ ওই ব্যক্তি এও বলতে দ্বিধাবোধ করে না : ‘তাই বলি, জগতেরে ছেড়ে দাও, থাক সে যেখানে যাবে,/হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম আর পুলকে বধির৷ যে সব খবর নিয়ে সেবকেরা উত্সাহে অধীর/আধ ঘণ্টা নারীর আলস্যে তার ঢের বেশি পাবে৷’ এই ব্যক্তি সেই ব্যক্তি যে উপনিবেশবাদের ভূমি-থেকে উত্পাটিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নহীনভাবে উদযাপন করে৷ এই ব্যক্তির দেহ ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে; এই ব্যক্তির ভাষাও ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে৷ অন্য কথায়, এই ব্যক্তির দেহ সংরক্ত হয়ে বস্তুক আয়তন ও অবয়ব লাভ করলেও তা শেষ পর্যন্তভুতুড়েই বটে৷
বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পবিত্র সরকার একটা কথা বলেছিলেন এভাবে : যে কবি বাস্তববাদী নয় সে মৃত৷ কিন্তু যে কবি শুধুই বাস্তববাদী সেও মৃত৷ বাক্যের অদল বদল করে এও বলা যাবে : ‘যে কবি শুধুই বাস্তববাদী সে মৃত৷ কিন্তু যে কবি বাস্তববাদী নয় সেও মৃত৷’ কিন্তু বুদ্ধদেবকে বাঙালি মধ্যবিত্তই বাঁচিয়ে রেখেছে৷ তিনি আছেন তার একাধিক অবদানের কারণেই৷ সব্যসাচী লেখকদের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা৷ আর কবিতার নতুন নির্মাণের স্বার্থেই বার বারই বুদ্ধদেব বসুকে স্মরণ করতে হয়; দেখে নিতে হয় তার প্রভাব কতটা গভীর ও কেন৷
লেখকঃ আজফার হোসেন
0 মন্তব্য:
Post a Comment