বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যসাধনার বিপুলতা কেবল রবীন্দ্রনাথের খন্ডাংশের সঙ্গে তুলনীয়। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, আত্মজৈবনিক রচনা, ভ্রমণকাহিনী−সব মিলিয়ে তিনি অতুল বৈভবময় সৃষ্টিজগতের অধীশ্বর। আধুনিক সাহিত্যকাল খন্ডায়নের, বিচুর্ণায়নের, নানা একদেশদর্শিতার−আধুনিক সাহিত্যিকজীবন নামক বিশাল-বিপুল যজ্ঞের এক কণাংশের খবরদারি পেলে বর্তে যান। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদের অন্যতম ধারক ও প্রচারক হওয়া সত্ত্বেও নিজের সৃষ্টিশীলতাকে সংকীর্ণতায় নিবিষ্ট করেননি। তিনি দৃশ্যত সেই ধরনের বৈশ্বকোষিক সাহিত্যিকদের মধ্যে শেষতম, যাঁদের দেখা অধুনাপূর্ব যুগে সচরাচর মিলত, যাঁরা সমুদ্রসন্ধানী ছিলেন, যাঁরা একই সঙ্গে সৃজনকলার নানা ভঙ্গিমাকে আরাধ্য করতে পেরেছিলেন। জন্নশতবার্ষিকীর শুভক্ষণে বাংলা সাহিত্যের এই নিবিষ্ট সাধককে অভিবাদন জানাই।
কিন্তু বর্তমান এই নিবন্ধকে যদি শুধু শ্রদ্ধাবাসর করে তুলি, তবে তা কপটতার নামান্তর হবে। আমাদের প্রয়োজন হলো বুদ্ধদেব বসুর উত্তরাধিকারকে বুঝে নেওয়া। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব অনেকটা অবিসংবাদিত হলেও কবিতায় দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর গৌরবময় ভুমিকা সত্ত্বেও তিনি কেন পুরোধাদের মধ্যে গুণক্রমে জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, এমনকি সুধীন্দ্রনাথেরও পশ্চাদ্বর্তী হলেন এবং তাঁর প্রবল শিষ্যদের নানা শ্রমী উদযোগ সত্ত্বেও তরুণ পাঠকদের কাছে কেন তিনি অনাদরণীয় থাকছেন, তার একটি অনুসন্ধান আজ করা যেতেই পারে।
আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় নামের দীপ্তি ত্রিপাঠী-রচিত প্রবাদপ্রতিম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। বুদ্ধদেব বসুর বয়স তখন পঞ্চাশ, তাঁর কাব্যখ্যাতি প্রতিষ্ঠিত; পুনরপি বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা নামের প্রবলপ্রতাপী ও প্রভাবক অনুবাদগ্রন্থ, যেটি অচিরেই উভয় বাংলার তরুণদের ‘আঁখি হতে ঘুম’ হরণ করে নেবে, প্রস্তুয়মান, এবং তাঁর সামনে ‘পথ রুধি’ কোনো ‘রবীন্দ্র ঠাকুর’ বর্তমান নেই। সেই ঘটনার পর আরও পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে; শতাব্দী-ক্রান্তির অন্য আলোয় বুদ্ধদেব বসুকে শুধু নয়, সমগ্র আধুনিক কাব্যমন্ডলকে পুনর্বিচারের প্রয়োজনীয় দুরপ্রেক্ষা আমরা অর্জন করতে পেরেছি বলে আমার ধারণা।
ত্রিপাঠী তাঁর আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় গ্রন্েথ তিরিশ-উত্তর বাংলা কবিতার নাম দিয়েছেন আধুনিক বাংলা কাব্য। এরও পাঁচ বছর আগে বুদ্ধদেব বসু স্বয়ং তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহ-র ভুমিকায় আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায়ন প্রচেষ্টা করেছেন এভাবে: ‘... এই আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকল শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্নয়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন-ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।’ এই সংজ্ঞায়ন যে দ্বিধাগ্রস্ত মাধবীর মতো দোলাচলে দীর্ণ তা বেশ বোঝা যায়। ত্রিপাঠী, বুদ্ধদেবের অনুরাগিণী গবেষক, তাঁর বইতে এই দোলাচলকে ঢাকতে চেয়েছেন, কিন্তু আমরা বুদ্ধদেবের মন সহজে বুঝতে পারি। য়ুরোপীয় আধুনিকবাদ (আধুনিকবাদ শব্দটি অবশ্য বুদ্ধদেব বা ত্রিপাঠী কেউই ব্যবহার করেননি) কবিতার যে সব লক্ষণ নির্দেশ করেছে, সেখানে ‘বিস্নয়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ’ প্রভুত থাকলেও, ‘বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি’ রয়েছে বললে সত্যের অপলাপ হবে। বিশ্ববিধানে এবং এর নিয়ন্তার অস্তিত্বে আস্থাকে ভুমিহীন করার মধ্য দিয়েই অথবা এর ভুমিহীন হওয়ার কারণেই আধুনিক কবিতা তাঁর স্থান করে নিয়েছে নৈরাশ্য আর সংশয়ের পোড়োজমিতে। ‘আকাশভরা সুর্য-তারা বিশ্বভরা প্রাণ’ দেখে ‘বিস্নয়ে’ যাঁর প্রাণ জেগেছিল, তিনি তো ‘প্রাগাধুনিক’ মানুষ রবীন্দ্রনাথ, যাঁর চিত্তবৃত্তিকে অস্বীকার করার মধ্যেই তো ছিল বুদ্ধদেব বসুদের বিদ্রোহ। দীপ্তি ত্রিপাঠী আধুনিক কবিতার যে লক্ষণসংহিতা রচনা করেছেন, সেই দ্বাদশ লক্ষণের মধ্যে ‘বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি’ নেই, বরং আছে ‘ভগবান এবং প্রথাগত নীতিধর্মে অবিশ্বাস’। বুদ্ধদেব বসুকৃত আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলা যায়। মনে হয় তিনি অনেকটা নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে ওই উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। একদা তিনি বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদকে আবাহন করতে গিয়ে কবিতার যে অন্বিষ্ট স্িথর করেছিলেন, তাতে প্রাধান্য ছিল নন্দনবাদিতার, কবির আত্মতার সগর্ব প্রতিষ্ঠা এবং কবিতাকে সমাজপ্রসঙ্গ, নৈতিকতা ও উপযোগিতাবাদ থেকে মুক্ত করে আনন্দের সাহিত্যের আয়োজন। সেখানে ‘বিদ্রোহের, প্রতিবাদের’ কোনো স্থান ছিল না। বুদ্ধদেবের কবিতায় ‘সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের’ চিহ্ন নেই; প্রেমের অসংবৃত উচ্ছ্বাসে আবিল তাঁর প্রথম যৌবনের কবিতা। (স্নর্তব্য, ‘সেরেনাদ’, ‘কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি কবিতায় “কঙ্কা, কঙ্কা, কঙ্কাবতী গো” ধরনের আর্তনাদ। বস্তুত, বুদ্ধদেব যে নজরুলের কবিতা সম্পর্কে কালের পুতুলে মন্তব্য করেছিলেন, “একটি দুটি স্নিগ্ধ কোমল কবিতা ছাড়া প্রায় সবই ভাবালুতায় আবিল”, তা তাঁর নিজের প্রেমের কবিতা সম্পর্কেও অনেকটা প্রযোজ্য।) আর তাই বুদ্ধদেব যখন আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহ সম্পাদনা করছিলেন, তিনি নিজেকে আবিষ্ককার করেন এক বিপুল আয়রনির মধ্যে। তাঁর নিজস্ব আধুনিকতার ধারণার সঙ্গে তাঁর সহযাত্রী-অনুগামীদের মিল নেই এবং তাঁর আত্মতা ও অহংনির্ভর কলাকৈবল্যবাদ কোনো পরিসর পায়নি বাংলা আধুনিক কবিতায়। ওই সংকলনটির সম্পাদনা বুদ্ধদেব বসুর কৃতিত্বের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হলেও এক অর্থে তাঁর নিজের কাব্য-বঃযড়ং-এর মর্মান্তিক পরাজয়ের স্নারকও বটে। নাহলে, কিমাশ্চর্যম, তিনি জসীমউদ্দীনের কবিতাকেও তাঁর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন! তিনি বিস্নয়বিস্কারিত দৃষ্টিতে দেখছিলেন যে, আধুনিক বাংলা কবিতা তাঁর প্রকল্পিত অতি-নান্দনিকতার পথে মোটেই এগোয়নি, বরং বহু বিরুদ্ধপ্রবণতার প্রবল সংঘাতে ও মিথস্ক্রিয়ায় এক আশ্চর্য জটিল রসায়ন হয়ে উঠেছে−যার অংশভাক্ হওয়ার সাধ্য তাঁর আর ততদিনে অবশিষ্ট নেই।
বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতাকে ও সেই সঙ্গে আধুনিক কবিদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছিলেন, এ রকম একটি সযত্নরচিত মিথ প্রবল হয়েছে দীপ্তি ত্রিপাঠীর গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাঙলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রায় ধর্মগ্রন্েথর মতো এ বইটি পাঠ করে। তাঁদের চিন্তায় অনপনেয় মুদ্রিত হয়ে যায় একজন কাব্য-ক্রুসেডারের ছবি, যিনি বাংলা কবিতাকে রবীন্দ্রনাথের ‘কুপ্রভাব’ থেকে মুক্তি দিয়ে আধুনিকতার আঙিনায় মেলে দিয়েছেন; যেন তিনি সেই অপেক্ষিত ভগীরথ, যার অবর্তমানে বাংলা কবিতার স্রোতস্বিনী শুকনো চড়ায় আটকে যেত। ‘প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে প্রগতি পত্রিকায় তিনি আধুনিক কাব্য-যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিলেন এবং বাধাবিঘ্ন সত্ত্বে আজও নৈষ্ঠিক ঋত্বিকের মতো সে-অগ্নি রক্ষা ক’রে চলেছেন। অজস্র কবিতা তিনি রচনা করেছেন, একমাত্র কবিতার জন্যই বিশ বছরের অধিক কাল পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন, কাব্য আলোচনার মাধ্যমে আধুনিক বহু কবিকেই রসিকসমাজে পরিচিত করেছেন এবং সহূদয়হূদয়সংবাদী পাঠকগোষ্ঠি সৃজন করেছেন।’ অনস্বীকার্য যে, বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবি ও কবিতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাঁর রচনাবলির বিশালত্ব ও বৈচিত্র্যও তাঁর বিরাট প্রতিভার স্বাক্ষর। কিন্তু সেইজন্য তাঁকে তিরিশের আধুনিক কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য বলা যায় না। তাঁর নিজের কবিতায় আধুনিকবাদের যে রূপটি তিনি ধারণ করেছেন, সেটি তিরিশের অন্য কবিদের থেকে আলাদা। আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রার্থিতও বটে, কিন্তু যে ব্যাপারটি বিস্নয়কর সেটি হলো, অন্য সব কবির কাব্যাদর্শ, ভাষা ও আঙ্গিক ক্রমবিবর্তমান হলেও এবং শৈল্পিক পরিণতির দিকে অগ্রসরমাণ হলেও বুদ্ধদেবকে মনে হয় এক জায়গায় স্িথর; তাঁর কোনো বিবর্তন নেই। একই প্রগল্ভ উচ্ছ্বাস বন্দীর বন্দনা থেকে মরচে পড়া পেরেকের গান পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর কবিতায় অনুপস্িথত মানসিক দ্বন্দ্ব যা আধুনিক কবিতার একটি মৌল লক্ষণ। জীবন ও ভালোবাসার অদ্বৈতে বিশ্বাসী বুদ্ধদেব বসু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছেন শরীরী প্রেমের কবি; নারী ও বাণীরে তাঁর এক মনে হয়েছে সারা জীবন। কিন্তু জীবন মানেই নারী অথবা নারীর প্রেম−এটি একটি বিষম সমীকরণ, একটি একদেশদর্শিতা। জীবনের আরও বহুতল আছে, আছে মানুষের নানাবিধ আস্তিত্বিক-সামাজিক সংকট। তিরিশের অন্য কবিরা, এমনকি সুধীন্দ্রনাথের মতো নিবিষ্ট প্রেমের কবিও সেইসব প্রস্তাবনাকে কবিতায় ঠাঁই দিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর বেলা অবেলা কালবেলা ও সাতটি তারার তিমির পর্যায়ে মহাপৃথিবী ও মহাকালের অনুধ্যান করেছেন। বুদ্ধদেব বসু প্রেমের কবিই থেকে গেছেন আজীবন−ব্যাপারটি এক অর্থে সংবর্ধনাযোগ্য হলেও সামূহিক বিচারে মনে হয় বুদ্ধদেবের মতো বিরলপ্রতিভ মানুষের জন্য এক বিরাট অপচয় এবং বাংলা কবিতার ক্ষতি। এর একটি কারণ, প্রেমের কবিতাতে তিনি নতুন কোনো মাত্রা যোগ করতে পারেননি, আনতে পারেননি এমন কোনো সুর যা আমরা রবীন্দ্রনাথে শুনিনি, কেবল রিরংসা ও দেহবাদিতার ফ্রয়েডবাহিত অনুষঙ্গটি ছাড়া। অবশ্য সেটিও কল্লোলের কবিকুল তথা মোহিতলালের কবিতায় প্রবলভাবেই মূর্ত হয়েছিল। এলিয়টপ্রেমী বুদ্ধদেব তাঁর গুরুর কাছাকাছিও আসতে পারেননি আধুনিক চৈতন্যের দ্বিধাসংকট চিত্রায়ণে: এলিয়টের প্রুফ্রক যে দ্বিধার করাতে দ্বিখন্ডিত, যে ক্ষণিক উৎসাহ এবং পরক্ষণের অনিবার্য নির্বেদ ও নৈরাশ্যের কাঁটায় ‘কলে-পড়া জন্তুর মতো অসহায়’ মোচড়ায় সে (‘Do I dare/Disturb he universe?/In a minute there is time/For decisions and revisions which a minute will reverse.’) তা বুদ্ধদেবের প্রেমিক-কথকের চিন্তার বাইরে। এমনকি জীবনানন্দের লোকেন বোসও প্রুফ্রকের মতো সময়ের দ্বিরাচারে দীর্ণ: ‘সুজাতাকে ভালবাসতাম আমি−/এখনো কি ভালবাসি?/সেটা অবসরে ভাববার কথা/অবসর তবু নেই.../সে-ও কি আমায়−সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?/আজো ভালোবাসে না কি?/ইলেক্ট্রনেরা নিজ দোষগুণে বলয়িত হ’য়ে রবে;/কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে এর উত্তর হবে?’ (‘লোকেন বোসের জার্নাল’) কিন্তু বুদ্ধদেবের প্রেমিকের মনে এ রকম কোনো ‘overwhelming questions" উত্থিত হয় না; তাঁর নির্দ্বিধ স্বস্তিবোধ আধুনিক মানসতার সুচক মনে হয় না, মনে হয় যেন এক প্রশ্নহীন কিশোরসুলভ মুগ্ধবোধের উচ্চারণ: ‘কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;...তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,/ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।/গাড়ি চ’লে গেলো! −কী ভালো তোমাকে বাসি, কেমন ক’রে বলি।’ (‘চিল্কায় সকাল’) সারা জীবনের কাব্যসাধনাকে তিনি যথার্থই এবং সততার সঙ্গে, বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘যা কিছু লিখেছি আমি−হোক যৌবনের স্তব, অন্ধ জৈব/আনন্দের বন্দনা হোক না−/যা-কিছু লিখেছি, সব, সবই ভালোবাসার কবিতা,/...আজ যদি ভাবি মনে হয়/ নারীরে, বাণীরে এক মনে হয়।/মনে হয় আমার তনুর তন্তুর সীবনে/যে-কবিতার ভালোবাসা ছিলো, তারই শ্বেত শিখার পদ্মেরে/ফুটিয়েছি মনে মনে নারীরে মৃণাল ক’রে;’ (‘মৃত্যুর পরে: জন্েনর আগে’, শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর)
অনেক সমালোচকই এমন প্রেমসর্বস্ব বুদ্ধদেব বসুকে ছেড়ে কথা বলেননি। একজনের মূল্যায়ন এমন: ‘(বুদ্ধদেব বসুর) নারী-চেতনাও মুখ্যতঃ প্রেম-নির্ভর, এবং সে-প্রেমও আবার সর্বাত্মক যৌনতা-নির্ভর।...কিন্তু প্রেম ছাড়া জগতের আর কিছু সম্পর্কে অন্ধতা, কিংবা নারীর পরিচয় একমাত্র প্রেমে, এবং প্রেমের পরিচয় একমাত্র যৌনতায় লুটোপুটি খাওয়ায়, একি আধুনিক মনের জগৎ সম্পর্কে ত"গত দৃষ্টিভঙ্গি? বুদ্ধদেব অত্যন্ত শক্তিশালী কবি, তাঁর কবিতা কবিত্বের দিক দিয়ে অতুলনীয়ভাবে সার্থক; তাঁর চিত্রকল্প, শব্দসম্ভার, অনুপ্রাস, অলঙ্কার, কাব্যরীতি মৌলিক, আত্মপ্রতিষ্ঠ, অভিনব, অপূর্ববস্তুনির্মাণক্ষমপ্রজ্ঞার পরিচায়ক। কিন্তু সব সত্ত্বেও জীবনের আরও বিভিন্ন দিকের বিচিত্র লীলা ও বিবিধ প্রকাশকে উপেক্ষা করা−এ কি আধুনিক সচেতন নিরাসক্ত মানসের পরিচয়বহ?’−(বারীন্দ্র বসু, কবিতা আধুনিকতা ও আধুনিক কবিতা, রত্নাবলী, কলকাতা ১৯৮৭, পৃ: ৭৯-৮০) কৌতুকের ও স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বুদ্ধদেবের কবিতা তখনই শাণিত ও আধুনিক মননস্পর্শী হয়েছে, যখন তিনি প্রেম ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তাঁর স্নরণীয় কবিতা ‘ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা’, ‘ব্যাং’, ‘ইলিশ’, ‘টাইগার হিলে সুর্যোদয়’, ‘মাছ ধরা’, ‘ইকারুস’, ‘বেশ্যার মৃত্যু’ ইত্যাদির বিষয় প্রেম-রিরংসার বাইরে।
বস্তুত, বুদ্ধদেব বসু তাঁর লেখালেখি ও পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে এবং তাঁর প্রবাদপ্রতিম শিষ্যায়নক্ষমতার মাধ্যমে আধুনিক কবিদের যেমন প্রতিষ্ঠ করেছেন, তারচেয়ে অনেক বেশি করতে চেয়েছেন নিজের কাব্যাদর্শের প্রতিষ্ঠা, যে কাব্যাদর্শ মডার্নিজমের একটি বিশেষ, সংকুচিত রূপ। ইংল্যান্ডের প্রি-র্যাফায়েলাইট-কবিকুলবাহিত, ওয়াল্টার-পেটারের ঈস্েথটিসিজমের আদর্শে পরিপুষ্ট নান্দনিকবাদ বা কলাকৈবল্যবাদ যার নাম। তাঁর সমস্ত কাব্যকর্মে অমোচনীয় লেগে আছে তাঁর অনড় নান্দনিকতত্ত্ব: তিনি যে আনন্দবাদী সাহিত্যের সাধনা করেছেন, সেখান থেকে সমাজ-সংসার প্রায় নির্বাসিত−শুধু জেগে আছে তাঁর প্রবলপ্রতাপান্বিত একমেবাদ্বিতীয়ম অহং। অস্িনতাভাবনাকে এতটা তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া একমাত্র বুদ্ধদেবের মতো পাশ্চাত্যকলাভাবিত, পড়ুয়া, বিচ্ছিন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাঁর এই ব্যক্তিগত, গবাক্ষহীন ঘরে (‘প্রান্তরে কিছুই নেই, জানালায় পর্দা টেনে দে’) শুধু তাঁর প্রিয়তমা কঙ্কার অধিবাস, যেখানে আসঙ্গপিপাসু-রূপবুভুক্ষু একজন ডেকাডেন্ট তাঁর হাতের তালুতে নিয়ে আঘ্রাণ করেন ইন্দ্রিয়ঘনত্বের সুগন্ধি। ‘আমার আকাঙ্ক্ষা তাই কবিত্বের অদ্বিতীয় ব্রত,/সংঘহীন সংজ্ঞাতীত এককের আদিম জ্যামিতি−/স্তব্ধতার নীলিমায় আত্মজাত পূর্ণতার বাণী।’ (‘উৎসর্গপত্র’, দময়ন্তী) সংঘহীন একাকীত্বের আদিম জ্যামিতি জীবনানন্দেরও অনুধ্যেয় ছিল, কিন্তু জীবনানন্দের কথিত ‘নির্জনতা’র সঙ্গে বুদ্ধদেবের আত্মাপসারণের পার্থক্য রয়েছে। জীবনানন্দ নিজের স্বভাবদোষে আলাদা হয়েছেন; তাঁর আত্মমুখিনতা তাঁর স্বভাবজাত ও স্বতঃস্কুর্ত। বুদ্ধদেব শিষ্যপরিবেষ্টিত, নবসাহিত্যান্দোলনের বৈতালিক বসু, সচেতনভাবে, কৌশল হিসেবে বেছে নিলেন, অন্তত কবিতায়, সমাজরিক্ততার, অনঘ আত্মতার পথ। তাঁর ‘রাত তিনটের সনেট: ১’-এর উদ্ধৃতি দিই। কবির প্রশ্ন, ‘যীশু কি পরোপকারী ছিলেন, তোমরা ভাবো? না কি বুদ্ধ কোনো সমিতির/মাননীয় বাচাল, পরিশ্রমী, অশীতির/মোহগ্রস্ত সভাপতি?’ সুতরাং কবির পরামর্শ, ‘জগতেরে ছেড়ে দাও, যাক সে যেখানে যাবে;/হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম, আর পুলকে বধির।/যে-সব খবর নিয়ে সেবকেরা উৎসাহে অধীর,/আধ ঘণ্টা নারীর আলস্যে তার ঢের বেশি পাবে।’ বিশুদ্ধ আনন্দের পূজারি বুদ্ধদেব ‘পুলকে বধির’ ছিলেন, কালের সমূহ কলাপ কিংবা ক্রন্দন তাঁর কানে পৌঁছায়নি; তিনি থেকে গেছেন নিরুত্তাপ, নিরুত্তেজ রূপসাধক। তবে কালের কৃপাণের সামনে প্রবলপ্রতাপী সম্রাটকেও দাঁড়াতে হয়। বুদ্ধদেব বসুকে কেন যেন মনে হয় আত্মবিশ্বাসহীন ও সশঙ্ক−অন্তত আধুনিক বাংলা কবিতার ভুমিকায় তাঁর দ্বিধাদীর্ণ দোলাচল আমাদের কাছে অস্পষ্ট থাকে না।
লেখকঃ খোন্দকার আশরাফ হোসেন
0 মন্তব্য:
Post a Comment