‘বুদ্ধদেব বসুর জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত ছিল ঢাকা শহর, যেমন ছিল আমার মা ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা রানু সোম থেকে কলকাতার বিখ্যাত লেখিকা হয়ে ওঠা প্রতিভা বসুর জীবনও।’ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসুর ছোট মেয়ে দময়ন্তী বসু সিং। সঙ্গে পুরানা পল্টন নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর উচ্ছ্বাসভরা অপ্রকাশিত চিঠি
বাবা বিষয়ে ব্যক্তিগত স্নৃতিচারণা আমি বহুবার বহু জায়গায় করেছি। বিক্ষিপ্ত লেখা ছাড়াও, বুদ্ধদেব বসুর চিঠি: কনিষ্ঠা কন্যা রুমিকে গ্রন্থটি যেহেতু বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের একটি প্রামাণ্য নথি, সেখানে একটি বিস্তৃত ‘স্নৃতি’ অংশ−বস্তুত যাকে ‘মেমোয়ার’ বলা চলে−প্রাক্কথন হিসেবে যুক্ত আছে। আমার বিদেশ গমনের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ‘কবিতা ভবন’-এ (২০২ রাসবিহারী এভিনিউ) জীবনের প্রথম বাইশ বছর কাটাবার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা জরুরি ছিল বইটিকে সম্পুর্ণ করতে। প্রতি চিঠির সঙ্গে দেওয়া আমার টীকা এবং এই দীর্ঘ স্নৃতিচারণা প্রকাশের পর ব্যক্তিগত পারিবারিক গল্প নেহাত পুনরাবৃত্তি হবে। কিন্তু সম্পাদক মশাই ব্যক্তিগত রচনার দাবিতে অনড়।
কী লিখি বলুন তো? বুদ্ধদেব বসু বিষয়ে, তাঁর পরিবার বিষয়ে আপনাদের অজানা তো কিছুই নেই। আপনারা আমার বাবাকে যত ভালোবাসা দিয়েছেন, যত মান্য করেছেন, যত মনোযোগ দিয়ে তাঁর লেখা পড়েছেন, যত আদরে তাঁকে ঢাকার মানুষ বলে আপন করেছেন, সেও তো তুলনারহিত। আপনারাই পুরানা পল্টনে হাঁটেন, যেতে পারেন রমনায়, পড়তে পারেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে, জগন্নাথ হল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আপনাদেরই। সদর্থে, আপনারাই তো তার উত্তরসুরি। আমি-আমরা তো সেখানে হেরেই আছি আপনাদের কাছে। ইচ্ছার সারল্যে ভাবি, ঢাকা গেলেই বুঝি ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের টিনের ছাদ দেওয়া ছোট্ট বাড়িটি দেখতে পাব, যেখানে আমার বাবা ছোট থেকে বড় হয়েছিলেন, ‘মর্মবাণী’র রাবীন্দ্রিক কিশোর কবি পৌঁছেছিলেন ‘বন্দীর বন্দনা’য়−সারা বাংলা কাঁপিয়ে দেওয়া এক দুঃসাহসী প্রতিভা! নিজেরই মতো সাহিত্যপ্রাণ, প্রতিভাবান এবং মেধাবী কিছু বন্ধু জুটিয়ে নিয়ে বের করেছেন প্রগতি পত্রিকা−প্রথমে তার মুক্তাক্ষরে খচিত, পরে রীতিমতো ছাপাখানায় মুদ্রিত মাসিক। ভাবি, আমিও বুঝি হাঁটব পুরানা পল্টনের মাঠে, চুল উড়িয়ে পাগল করা বাতাসে, উদাত্তকন্ঠে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে যেমন সেই যুবকবৃন্দ করতেন। তা হয় না, তা হওয়ার নয়−জেনেও অবোধ কল্পনা ডানা মেলে ওড়ে।
১.
বুদ্ধদেব বসুর জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত ছিল ঢাকা শহর, যেমন ছিল আমার মা ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা রানু সোম থেকে কলকাতার বিখ্যাত লেখিকা হয়ে ওঠা প্রতিভা বসুর জীবনও। যেকোনো মানুষের জীবনেই পিতা-মাতার প্রভাব সবচেয়ে গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। শৈশব থেকেই আমরা সচেতনে-অচেতনে তাঁদের পদচিহ্ন অনুসরণ করি। তাঁদের মূল্যবোধে আমাদের চরিত্র গঠন হয়, তাঁদের ভালো লাগা-ভালোবাসার মানুষজন ও জায়গাগুলো অজান্তেই আমাদের আপন হয়ে ওঠে। আমার মা-বাবা দুজনেই কট্টর ‘পূর্ববঙ্গীয়’ ছিলেন, কখনোই তাঁরা নিজেদের ঢাকার মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবেননি। আশ্চর্য লাগে ভাবতে সেই ভুমিখন্ড এখনো আমার অদেখা, যেখানে আমার মা-বাবাই শুধু নন, আমার সমস্ত পূর্বপুরুষ জন্েনছিলেন। মা-বাবা দুজনেই যে শহরে বড় হয়েছিলেন, বিখ্যাত হয়েছিলেন, পরস্পরকে প্রথম দেখেছিলেন, সেই ঢাকা শহরের কথা তাঁরাও কখনো ভোলেননি, আমাদেরও ভুলতে দেননি। ঢাকার প্রতি মা-বাবার নস্টালজিয়া আমাদের মধ্যে বাহিত হয়ে এসেছিল অতি স্বাভাবিকভাবে। নিজেদের ‘পূর্ববঙ্গীয়’ পরিচয়ে আজও প্রচন্ড শ্লাঘা অনুভব করি আমরা। জীবনে ঢাকা না দেখে, বিক্রমপুর-মালখানগর-হাসারা না দেখে, সর্বতোভাবে সে দেশের মানুষ বলে নিজেদের এখনো যে আমরা দাবি করি সেও মা-বাবার থেকে আহূত উত্তরাধিকার। কলকাতাই আমাদের একমাত্র শহর হওয়া সত্ত্বেও কদাপি নিজেদের ‘পশ্চিমবঙ্গীয়’ ভাবি না আমরা। দেশ-গাঁ দেখিনি তো কী, বাবা-মার দেশই আমাদের। এখনো আমরা ঢাকা-বিক্রমপুরের লোক, মালখানগরের বসুঠাকুর! আমাদের শিকড় বদ্ধমূল সেই না-দেখা দেশে−পূর্বপুরুষের অস্তিত্বহীন ভিটেয়। পরিস্িথতি ও স্থানকালের পরিবর্তন কিছুই যেন বদলাতে পারে না−লক্ষ-হাজার উদ্বাস্তু এসে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে স্থায়ী বসত গড়ে পূর্ব-পশ্চিমের সব ভেদাভেদ মুছে দেওয়ার পরেও।
এখানে আমাদের পরিবারের একটা নিত্যকার গল্প বলি। ব্যক্তিগত কথাই যখন লিখতে বসেছি বসু পরিবারের এই তথ্যটি লিপিবদ্ধ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বরং প্রকট হবে বুদ্ধদেব বসু-প্রতিভা বসুর সন্তানদের হাড়ে মজ্জায় ও-পার বাংলা এমনভাবে জড়িয়ে আছে কেন!
আমার মা ছিলেন হাসারার সোম, বাবা মালখানগরের বসুঠাকুর। এই বসুঠাকুরদের প্রতি মায়ের প্রবল বীতরাগ ছিল। আসলে তাঁর মামাবাড়িও ছিল মালখানগর−অর্থাৎ আমাদের দিদিমা ছিলেন সেই গ্রামের মেয়ে। ছোট থেকেই মা দেখেছেন তাঁর ভোজনে অত্যুৎসাহী ‘স্বার্থপুর’ দাদুকে (আমিও তাঁকে ছোট বয়সে দেখেছি। খুবই আশ্চর্য, জীবনভর গুরু-ভোজন করেও তিনি ছিলেন রীতিমতো ছিপছিপে চেহারার মানুষ), উগ্রচন্ডী মারকুট্টে মামাকে (ইনি অবশ্য সত্যিই পালোয়ানদের মতো বলিষ্ঠ গুন্ডাজাতীয় ছিলেন, যদিও সেই সময়ে জর্মানি থেকে পাস করা এরোনটিকেল ইঞ্জিনিয়ার−সম্ভবত তৎকালীন ভারতবর্ষের অতি-বিরলদের একজন।), এবং তাদের নিউক্লিয়ার সংসারের একচ্ছত্র সাম্রাজ্ঞী নিজের রাশভারি মা-কে। অনুরাগের পাত্র হিসেবে বুদ্ধদেব বসুকে নিজেই নির্বাচন করলেও বাবার পিতৃপুরুষের গ্রামটি মা-র একেবারেই পছন্দ ছিল না। কারণে-অকারণে বাবাকে তো বটেই, বেচারা আমাদেরও মা-র কাছে সমালোচনা শুনতে হতো মালখানগরের ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে। সম্ভবত শৈশবের কিছু অপ্রিয় স্নৃতি থেকেই তাঁর পরিষ্ককার পক্ষপাত ছিল হাসারা গ্রামের সোমেদের প্রতি। তাঁর বাবা, পিসি, কাকা, দাদু−মা-র মতে এঁরা ছিলেন নম্র, ভদ্র, বিনীত, সুক্ষ্মবোধের মানুষ, মালখানগরের লোকেদের মতো উগ্র নয়, আত্মকেন্দ্রিক নয়, ‘অভ্যাসের দাস’ নয়, দাপুটে নয়, সর্বোপরি লজ্জাহীনভাবে খাদ্য-সম্ভোগী (সোজা বাংলায় পেটুক) নয়! মা বলতেন, মালখানগরের লোকেরাই শুধু পারে এক খাওয়া শেষ হতে না হতেই আরেক খাওয়ার গল্প শুরু করতে। বড়ই তামসিক তারা। মায়ের সব অভিযোগই ভিত্তিহীন এমন হয়তো বলা যায় না, তবে আমরা বুক ঠুকে নিজেদের ‘বাঙাল’ বললেও আমাদের ওপর নঞর্থকভাবে সদাসর্বদা মালখানগরের তকমা লাগানোর ব্যাপারটা আপত্তিজনক মনে হতো, বিশেষত মা যখন একেবারেই সে গ্রামের লোকেদের পছন্দ করেন না। যে গ্রাম, শুধু আমরা নই, বাবাও জীবনে দেখেননি, সেই গ্রাম শুধুমাত্র মা-র দৌলতে স্থায়ীভাবে ‘আমাদের গ্রাম’ হয়ে গেল−বড় হতে হতে সেই গ্রামের সপক্ষে সওয়াল করতেও শিখলাম। সবই অবশ্য মহাশুন্যে লাট্টু ঘোরানোর মতো−বাস্তব ভিত্তি কিছুই নেই, সবই আছে শুধু মনের ভেতরে। কী অদ্ভুতভাবে মা চিরদিন রইলেন তাঁর বাপের বাড়ির অংশ হয়ে−স্বামী-সন্তান এমনকি নিজের মা-কে ‘বসুঠাকুর’ ক্যাম্পের আবাসিক করে দিলেন।
আমার কাছে এই ঘটনাটার বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে এর তাৎপর্য অসীম। সত্যিই কি এক-একটা ‘ক্ল্যানে’র কতগুলো সামান্য চরিত্রলক্ষণ থাকতে পারে? এ তো জিন নয় যে জন্নসুত্রে বাহিত হয়ে আসবে। হ্যাঁ, একটা ‘ক্ল্যান’ যদি বহুদিন সহবাস করে, একধরনের সামান্যমনস্কতা এক পরিবারের লোকের মতো তাদের মধ্যে চলে আসতেই পারে। কিন্তু সে প্রশ্ন যেখানে নেই, সেখানেও কি একই বংশের মানুষদের মধ্যে একই ধরনের চরিত্রলক্ষণ হওয়া সম্ভব?
আমাদের পরিবারের প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন জরুরি, কারণ আমার বাবা জীবনেও মালখানগরের মাটিতে পা রাখেননি; শুধু তাই নয়, তাঁর পিতার অথবা পৈতৃক পরিবারের কোনো প্রভাবই তাঁর জীবনে ছিল না। তিনি নোয়াখালীতে দাদু-দিদার (তাঁর দা এবং মা) কাছে শৈশব কাটিয়েছেন, জন্েনছিলেন কুমিল্লায়। অতি আদরে লালিত শিশু, মা-বাবার অভাব তিনি কখনো জানেননি। কৈশোরে মা এবং দা’র হাত ধরেই চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর জীবনের পুরো ছবিতে মালখানগর কখনোই আসে না। আমাদের প্রসঙ্গ তো না তোলাই ভালো−আমরা তো তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কিছুই দেখিনি। তবুও কি আমাদের স্বভাবে বসুঠাকুর ক্ল্যানের চরিত্রলক্ষণ ছিল? মা নইলে বলবেন কেন? নাকি তাঁর দাদু এবং মামা, হয়তো কিয়দংশে অতীব ব্যক্তিত্বশালিনী মা, এই গ্রামের মানুষদের বিষয়ে কতগুলো বদ্ধমূল ধারণার জন্ন দিয়েছিল মা-র মধ্যে? তবে পরবর্তীকালে কিছু বসুঠাকুরদের দেখে আমরাও কিন্তু তাঁদের মধ্যে স্বভাবগত কিছু কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করেছি। সেগুলো মায়ের সুতীক্ষੲ বিশেষণগুলোর সঙ্গে সর্বাংশে মেলে এমন অবশ্য নয়, তবে খাওয়ার প্রতি এই গোষ্ঠীর কিছু কিছু ব্যক্তির যে সাধারণের চেয়ে অধিক আগ্রহ দেখেছি এ কথা সম্ভবত বলা চলে। আর একটি সাদৃশ্য এঁদের রসিকতার প্রবণতায়। যাকে আমাদের বাড়িতে বলা হতো ‘বল্দা রসিকতা’। মা-র বাকি অপবাদগুলো তাঁর মামাবাড়ির অভিজ্ঞতাজাত বলেই মনে হয়। সত্যি বলতে মায়ের মামার মতো কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি আমি আর কোথাও দেখিনি। এ ছাড়া বলতেই হবে, তাঁর দাদুরও ভোজন ক্ষমতা ছিল অসীম। বাবা তো শেষ পর্যন্ত এঁদের স্নরণ করে ‘সাধুদাদু ও গাবুমামা’ বলে এক ছোটদের গল্পই লিখে ফেললেন!
২.
বাবা নিজে নিতান্ত মিতাহারী ছিলেন, কিন্তু অবশ্যই খাদ্যরসিক ছিলেন। ভোজ, ভোজ্য ও ভোজনকে যে তিনি শিল্পের পর্যায়ে তুলে এনেছিলেন তাঁর লেখায়, তা তো তাঁর সব পাঠকই জানেন। না হলে ‘ভোজনশিল্পী বাঙালি’র (এখানে ‘শিল্পী’ শব্দটি লক্ষণীয়। অনেক ভেবেচিন্তে নামটি দিয়েছিলেন।) মতো প্রবন্ধ, গোলাপ কেন কালোর মতো খাদ্য-নস্টালজিয়ায় ঋদ্ধ উপন্যাস, তিথিডোর-এ স্বাতীর বিয়ের ভোজের অসামান্য বর্ণনা−লিখতেন বা কী করে? বাবা অবশ্য মা-র কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হতেন না, কারণ জীবনে তিনি দুটি ভুমিখন্ডকে আপন করেছিলেন, প্রথম ঢাকা, দ্বিতীয় কলকাতা। এই দুই শহরকে একই আবেগে ভালোবেসেছেন মা-বাবা দুজনেই, কিন্তু বাবার শিকড় ছিল ঢাকায়, আর মা-র ছিল তাঁর দেশে−হাসারায়−যেখানে তাঁদের অভিন্ন হাঁড়ির প্রকান্ড যুক্ত-পরিবার ছিল চার দাদু, অনেক কাকা-পিসি আর রাশি রাশি তুতো ভাইবোনদের নিয়ে। তিনি সম্পন্ন জমিদার পরিবারের মেয়ে হিসেবে নিজেকে জানতেন। তাই গ্রামের গৌরব তাঁর ছিল। বাবার সেসবের বালাই ছিল না, অতএব ঢাকাই তাঁর সব পেয়েছির দেশ। তবে মায়ের নিজের ‘দেশ’ ছিল বলে তিনি বাবাকে এবং পিতৃসুত্রে আমাদেরও একটি ‘দেশ’ দিয়েছিলেন−অন্তত কোথাও যে আমাদের খুঁটি পোঁতা আছে সে বোধকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে শুনে শুনে শুধু ঢাকা নয়, আমরা হাসারা-মালখানগরকেও নিজেদের বলে জানতে শিখেছি। যেহেতু আমরা নিজেদের কখনোই পশ্চিমবঙ্গীয় ভাবতে পারি না, বলতে পারি না আমরা ‘কলকাতার লোক’, তাই আমাদেরও যে শিকড়ভুমি আছে−সদর্থে না থাকলেও অস্তিত্বে আছে−সেই জ্ঞানেও আমাদের সুখ। বাবার কাছে ঢাকা ছিল জন্নদাত্রী মা, কলকাতা পালক পিতা।
৩.
একটি চিঠি। লিখেছিলেন আকৈশোর প্রাণের বন্ধু পরিমল রায়কে, যিনি থাকতেন পুরানা পল্টনে বাবার আস্তানা থেকে অল্প দুরে ‘পরম ভবনে’। পরিমল রায় এ-পারে এসে স্থায়ী হন দিল্লিতে। বাবা এই চিঠিটি লিখছেন ১২ অক্টোবর ১৯৫১ সালে বাংলা-বিহারের বর্ডারে একটি (এখন সম্ভবত ঝাড়খন্ড) ছোট শহর চাঁইবাসা থেকে। বন্ধু ন্যু ইয়র্কে কর্মরত ইউনাইটেড নেশন্সের অর্থনীতিবিদ। চিঠিটি অংশত এখানে উদ্ধৃত করছি কেন তা স্বতই প্রতিভাত হবে।
পরিমল,
চিকিৎসাশাস্ত্রের উত্তরকান্ডে বায়ু পরিবর্তন নামক যে অধ্যায়টি আছে তার তাড়নায় আমরা কয়েকটি প্রাণী ছিটকে পড়েছি কলকাতার বাইরে। তুমি এখন মেটকাফ হাউসের বাদশারূপে অধিষ্ঠিত থাকলে হয়তো দিল্লিতেও দৌড়তুম, কিন্তু তুমি যেহেতু যমুনাতীরবর্তী সেই কক্ষবহুল ভবনটিকে অনাথ করে ইতিমধ্যে ন্যু ইয়র্কে চলে গেলে, তাই সিংভুম জেলায় চাঁইবাসা নামক জনপদটি এবার আবিষ্ককার করা গেলো। আছি শহরতলিতে; যাঁরা আশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের গার্হস্থ্য কলরব ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এখানে;−যদি না গাছের পাতার শোঁ শোঁ এবং গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার ছপছপ−এগুলি ‘শব্দে’র মধ্যে ধরো− খুব নির্জন নিস্তব্ধ জায়গাটা, চারদিকের দিগন্ত পাহাড়শ্রেণীতে ঘেরা, একটু উঁচু-নিচু উন্নুক্ত প্রান্তর যতদুর চোখ যায় চ’লে গেছে। ক-দিন ধ’রে মেঘবৃষ্টি চলছে; রাত্রে মেঘ-চোঁয়ানো অতি ক্ষীণ ভুতুড়ে জ্যোৎস্মায় ঈষৎ-উদ্ভাসিত দিগন্ত-ছোঁওয়া প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে পুরানা পল্টনের কথাই মনে পড়ছিল বারবার। কী মজা দ্যাখো, তোমার ন্যু ইয়র্কে গিয়ে পুরানা পল্টন মনে পড়ে, আমার মনে পড়ে চাঁইবাসা লক্ষেੲৗ দিল্লি এমনি নানা জায়গায় যেখানেই অনেক মস্ত মস্ত ফাঁকা মাঠ আছে;−মনে হয় পুরানা পল্টনের মতো, কিন্তু ঠিক সে রকম না; পল্টনের মাঠের মতো সুন্দর পৃথিবীর অন্য কোনো মাঠ আমাদের চোখে লাগবে না। তার কারণ এ নয় যে ঐ প্রান্তর রূপগৌরবে শ্রেষ্ঠ−ভাবতে গেলে জায়গাটা অতি সাধারণ ভিন্ন কিছুই নয়−কিন্তু ওখানে আমরা যুবক ছিলাম, উন্নীলিয়মান সদ্য যুবক, আমাদের কাছে সেটাই ওর মহিমা, যে মহিমার তুলনা নেই। আমার লেখার মধ্যে পুরানা পল্টনের কথা এতবার এসে গেছে যে ভেবে অবাক লাগে−খারাপও লাগে এক-এক সময়, মনে হয় বৈচিত্র্যের অভাব ঘটছে; তবু এখনো এক-এক সময় আবার নতুন ক’রে লিখতে ইচ্ছে করে; মনে হয় অনেক কথাই বলা হয়নি, সেখানকার দিন, রাত্রি, বিকেল, সন্ধ্যা, স্তব্ধ মধ্য রাত্রির আশ্চর্য নীল সিনেমার মতো জ্যোছনা, তার ঠিক সুরটি, স্পর্শটি, আবার নতুন ক’রে ধরতে ইচ্ছে করে। ...তুমি আবার চিঠি লিখো কলকাতার ঠিকানাতেই এবং পারো তো কিছু মার্কিন ছড়া পাঠিয়ো। সস্ত্রীক আমাদের বিজয়ার প্রীতি নিও।
বুদ্ধদেব
এ চিঠি ন্যু ইয়র্কে পৌঁছবার দু’দিন আগে মাত্র ৪২ বছর বয়সে পরিমল কাকার আকস্িনক মৃত্যু হয়। বন্ধুকে শোকবিহ্বল করে তিনি চলে গিয়েছিলেন কোন অসীম পরিসরে কে জানে! পুরানা পল্টনের নস্টালজিয়া থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন কি? বাবাকে দেখে মনে হয়েছে এ নস্টালজিয়া থেকে এঁদের প্রজন্েনর মুক্তি হওয়া সম্ভব নয়। কেন, তা এই চিঠিই বলে দেয়। পুরানা পল্টনের মাঠ জুড়ে আছে তাঁদের প্রথম যৌবন, তাঁদের তীব্র বন্ধুতা, তাঁদের অবাধ স্বাধীনতা, তাঁদের অন্তহীন স্বপ্ন। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে বাবার জন্য তা ছিল পুরানা পল্টনের মাঠ।
এই পরিবারে বড় হয়ে আমি নিজেকে ও-পারের মেয়ে ছাড়া কী-ই বা ভাবতে পারি! হয়তো ভালোই যে আমি কোনো দিন চক্ষু দিয়ে ঢাকা দেখিনি। থাক না আমার মা-বাবার দেশ আমার মানসে এক অপার্থিব স্বপ্ন হয়ে।
ঢাকা।
থাক না আমার মনের মধ্যে আঁকা
যাদু-মাঠের কল্প
পরিকথার গল্প
বাবার বোনা সৃষ্টি
মায়ের চোখের দৃষ্টি
আমার মনে স্বপ্ন হয়ে থাকা
ঢাকা।
(অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিতব্য একটি সংকলনের জন্য লেখা। লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।)
উৎসঃ প্রথম আলো
0 মন্তব্য:
Post a Comment