……
বন্ধু অজিত দত্তের সঙ্গে ঢাকায়, ১৯২৪
…….
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রথম দশকের ছাত্রদের একজন বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। ঊনিশ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৭ সালে ইংরেজি বিভাগের অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তি হন। চার বছর পর ১৯৩০-এ মাস্টার্স। শুধু সেই আদিকালের নয়, শোনা যায় এতাবৎকালের সেরা ছাত্রদের সেরা তিনি। এমন জনশ্রুতি আছে যে, তিনি ইংরেজি অনার্সে যে মোটনম্বর পেয়েছিলেন, তার রেকর্ড নাকি আজতক কেউ ভাঙতে পারেনি। আমি নিজে ইংরেজি বিভাগের সাথে ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে চার দশকের বেশি জড়িত আছি, কিন্ত ঐ কিংবদন্তীর সত্যতা চেষ্টা করেও, মহাফেজখানার অপ্রবেশ্যতাহেতু, যাচাই করতে পারিনি। তবে একথা ঠিক, বুদ্ধদেব বসুর তুল্য প্রতিভাবান কাউকে ইংরেজি বিভাগ আজ অব্দি সৃষ্টি করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা ছাত্রের শিরোপাও তাঁর প্রাপ্য।
বুদ্ধদেব বসুর কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়া এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। সেটি মোটামুটি সবারই আয়ত্ত। তবু সংক্ষেপে বলি, তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা, যুগস্রষ্টা কবি, নাট্যকার, বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদক, ঔপন্যাসিক ও প্রাজ্ঞ প্রবন্ধকার শুধু নন, তিনি রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাঙালির মননচর্যা ও নন্দনভাবনার উজ্জ্বলতম প্রতিভু। তিনি ছিলেন সেইসব বৈশ্বকোষিক লেখকদের একজন, রবীন্দ্রনাথের পরে এদেশে যাঁরা বিরলপ্রজাতির পাখির মতো দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথের রচনাসম্ভারের বিপুলতার সাথে যদিও তুলনা চলে না, তবু নেহাৎ কম নয় বুদ্ধদেব বসু-র সৃষ্টি। অবিরল ধারায় লিখেছেন তিনি, স্বতঃউৎসারে, গদ্যে-পদ্যে, বাংলায়-ইংরেজিতে; ব্যাখ্যা করেছেন নন্দনতত্ত্ব; লিখেছেন মহাভারতের নবতর ব্যাখ্যা; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা ক’রে তা লালন করেছেন; অসামান্য সব কাব্যনাট্যে বিধৃত করেছেন তাঁর জীবনভাবনা। তাঁর বোদলেয়ার-অনুবাদ অসম্ভব প্রভাবসম্পাতী হয়েছিল, এবং পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এই বাংলাদেশের তরুণ কবিদেরও আঁখি হ’তে ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো; তাঁর উপন্যাস তিথিডোর-এর পাঠকপ্রিয়তা ইদানীংকার সুনীল-সমরেশদেরও ঈর্ষার কারণ হতে পারে।
ফিরে আসি বুদ্ধদেব বসু-র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশের দশকের নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে আসেন নবীন বুদ্ধদেব, তখন তার আজকের দিনের বিপুল বিস্তৃতি ও কোলাহলময়তা ছিল না। শান্ত শহর ঢাকা ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গজিনত হঠাৎ-প্রাপ্তিতে রাজধানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। স্থাপিত হয়েছিল শহরের প্রান্তদেশে, রমনায়, বেশকিছু ইমারত, তার মধ্যে দুটি সুদৃশ্যতম — কার্জন হল এবং পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশের সচিবালয়, যেটি আজকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ। রমনা এবং নীলখেতের ঘনবৃক্ষশোভিত প্রায়-অরণ্যানী অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাজকর্মচারীদের উদ্যানশোভিত বাটীকাসমূহ। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলে ঢাকা শহর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ঝিমিয়ে পড়ে। সেই সুষুপ্তি থেকে আবার সে জেগে ওঠে রমনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর। পরিত্যক্ত সেক্রেটারিয়েটে বসে কলাভবনের ক্লাস, কার্জন হল সংলগ্ন ইমারতসমূহে বিজ্ঞান বিভাগ। ছড়ানো-ছিটানো রাজপুরুষদের বাড়িগুলোয় থাকতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। সবুজ রমনার বুকে শান্তশ্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ক্যাম্পাস আজ নেই: ছাত্রসংখ্যা ও অন্যান্য চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন তিল ঠাঁই আর নাহি রে। কিন্তু সেই বিশের দশকের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্থির চিত্র আজো অমলিন বেঁচে আছে বুদ্ধদেব বসুর আত্মস্মৃতিমূলক রচনায়, বিশেষত তাঁর আমার যৌবন-এ। সে-চিত্র স্মৃতিমেদুর ও মনোহর; ইংরেজিতে যাকে বলে idyllic। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো রমনা ও পুরানাপল্টন এলাকার যেসব বর্ণনা আছে তাঁর লেখায়, তার একটি archival value-ও রয়েছে। অসামান্য সেইসব বর্ণনা পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। পুরানা পল্টনের হিমকুয়াশাঘেরা মাঠের ভেতর টিনের বাড়ি, মেঠো পথ এখন মাথা খুঁড়েও ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ল্যান্ডমার্কগুলো এখনো আছে। আমি বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বসু-র উদ্ধৃতি দিই। “ভেতরে বাইরে জমকালো এক ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয। নিখিলবাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরা-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ-বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস: আছে ব্যায়ামাগার ও ক্রীড়াঙ্গন ও জলক্রীড়ার জন্য পুস্করণী — যেখানে-সেখানে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ। ইংলন্ডদেশীয় পল্লী-নিবাসের মতো ঢালু ছাদের এক-একটি দোতলা বাড়ি — নয়নহরণ, বাগানসম্পন্ন: সেখানে কর্মস্থলের অতি সন্নিকটে বাস করেন আমাদের প্রধান অধ্যাপকেরা: অন্যদের জন্যেও নীলখেতে ব্যবস্থা অতি সুন্দর। স্থাপত্যে কোনো একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়া দিল্লীর জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি। বিজ্ঞানভবনগুলি আরক্তিম ও তুর্কি শৈলীতে জাফরিখচিত, মিনারশোভন…।” আজকের যানজটকণ্টকিত নীলখেত মোড়ের কথা ভাবুন পাঠক। বুদ্ধদেবের সময় এর পরেই ছিল আদিগন্ত ধানক্ষেত, বহুদূরে সূর্য অস্ত যেত; নীলখেতের, মূলত ঢাকা শহরের, প্রান্তসীমা চিহ্নিত করে ছুটে যেতো রেললাইন। বুদ্ধদেব বসু-র বর্ণনায় নীলক্ষেতকে আজ মনে হবে রোমান্টিকতায়-নীল নিসর্গের মতো: “অচিরসমাপ্ত একটি পথ — একদিকে খানপাঁচ-সাত অধ্যাপক নিবাস, অন্যদিকে আদৃষ্টিসীমা প্রান্তর — শূন্য জমি, ঘাসের জমি, ধানখেত হয়তো, আর দূরে একখানা মস্ত গোল অবাধ আকাশ মাটির বুকে লুটিয়ে পড়েছে। বাড়িগুলো একতলা ও অনুচ্চ বলে ভূদৃশ্য ব্যাহত হয়নি; আর এই প্রাকৃত শোভাকে সুন্দরতর করে তীব্র একটা বাঁক নিয়ে চলে গেছে মৈমনসিংহের দিকে রেললাইন।” নীলখেতের ঐ অধ্যাপকনিবাসগুলোর কয়েকটি আশির দশক পর্যন্ত অটুট ছিলো: সেইসব একতলা ভবনের একটিতে, আমার সমকালীন ও কিঞ্চিত্তরুণতরদের মনে পড়বে, আবু সাঈদ হল নামে একটি অননুমোদিত ছাত্রাবাস গড়ে উঠেছিলো স্বাধীনতার পর-পর। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সুশোভন সরকার এবং বাংলার অধ্যাপক কবি মোহিতলাল মজুমদারের নীলখেত-আবাসে যাতায়াত ছিল বুদ্ধদেবের। আশির দশকে আধুনিক বহুতল শিক্ষকনিবাস শহীদ গিয়াসউদ্দিন এলাকা গড়ে তোলার সময় বুলডোজোরের শিকার হয় সেইসব বাড়ি।
কেমন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চেহারা সেসময়? বুদ্ধদেব লিখছেন: “আক্ষরিক অর্থে আবাসিক নয়, কিন্তু গড়ন কিছুটা সেই ধরনের: যে-সব ছাত্র স্বগৃহবাসী তাদেরও সংলগ্ন থাকতে হয় কোনো-না-কোনো ‘হল’ অথবা হস্টেলে — তাদের প্রাচীরাতিরিক্ত ক্রিয়াকর্মের সেটাই হলো ঘটনাস্থল। সেখানে আছে আলাদা-আলাদা গ্রন্থাগার ও রঙ্গালয় ও নানান ধরনের খেলার ব্যবস্থা; অনুষ্ঠিত হয় বিতর্কসভা, সংগীত-প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ভোজ, ও আরো অনেক সময়োচিত অধিবেশন : সেখানকার নাট্যাভিনয় দেখতে নগরবাসীরাও সোৎসাহে সমবেত হন। ক্লাশ ফুরোনোমাত্র কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক চুকলো, এমন এখানে হতেই পারে না — কেননা প্রায়ই আমাদের ফিরে আসতে হয় কোনো-না-কোনো সান্ধ্য অনুষ্ঠানে — মনোজ্ঞ না হোক অন্ততপক্ষে কৌতূহলজনক।” ঢাকার সাংস্কৃতিক জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কেন্দ্রীয় গুরুত্ব, হায়, বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। হলগুলোতে আর আগের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতে দেখা যায় না। কেন্দ্রীয়ভাবেও যা আয়োজিত হয় তা দায়সারা ও নিয়মরক্ষার আয়োজনমাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো দিনের এইসব বর্ণনা আমাদের মনকে কিছুটা হলেও বিষাদাক্রান্ত করে।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর আমার যৌবন-এ ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বর্ণনাও দিয়েছেন, জানিয়েছেন কীভাবে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, তাঁকে সাহিত্যসম্পাদক পদে নির্বাচন করতে হয়েছিলো। নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি, এবং সেই সুবাদে তাঁর চেষ্টায় “জগন্নাথ হল্-এর বার্ষিক পত্রিকা বাসন্তিকার কিছুটা হয়তো শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিলো সে-বছর।” এই জগন্নাথ হলেই প্রথম তিনি দেখেন নজরুল ইসলামকে এবং “অন্য অসংখ্যের মতোই দেখামাত্র প্রেমে” পড়েন তাঁর। নজরুলের জন্য বুদ্ধদেব জগন্নাথ হলে একটি সভা আহ্বান করেছিলেন, “তাতে ভিড় জমেছিলো প্রচুর, দূর শহর থেকে ইডেন কলেজের অধ্যাপিকারাও এসেছিলেন, তাঁর গান ও কবিতা-আবৃত্তি শুনে সকলেই মুগ্ধ: মৃত অথবা বৃদ্ধ অথবা প্রতিষ্ঠানীভূত না-হওয়া পর্যন্ত কবিদের বিষয়ে যাঁরা স্বাস্থ্যকরভাবে সন্দিগ্ধ, সেইসব প্রাজ্ঞদেরও মানতে হয়েছিলো যে ‘লোকটির মধ্যে কিছু আছে’।” পরে এক অধ্যাপকের বাড়িতে নজরুলের গান-রচনার প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনাও দিয়েছেন বুদ্ধদেব: কোন ডকুমেন্টারি ছবিও এতটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতো না সৃষ্টিসুখের উল্লাসে উদ্দীপিত নজরুলের সেই মনোহরণ দৃশ্য: “যেমন তাঁর গান গাওয়া নিষ্কুণ্ঠ তেমনি তাঁর রচনাও এক প্রকাশ্য ঘটনা: … সামনে হার্মোনিয়ম, পাশে পানের কৌটো, হার্মোনিয়মের ঢাকনার উপরে খোলা থাকে তাঁর খাতা আর ফাউন্টেনপেন — তিনি বাজাতে-বাজাতে গেয়ে উঠলেন একটি লাইন, তাঁর বড়ো-বড়ো সুগোল অক্ষরে লিখে রাখলেন খাতায়, আবার কিছুক্ষণ বাজনা শুধু — দ্বিতীয় লাইন — তৃতীয় — চতুর্থ — দর্শকদের নীরব অথবা সরব প্রশংসায় চর্চিত হয়ে ফিরে-ফিরে গাইলেন সেই সদ্যরচিত স্তবকটি: এমনি করে, হয়তো আধ ঘণ্টার মধ্যে, ‘নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরান-পিয়া’ গানটি রচনা করতে আমি তাঁকে দেখেছিলাম — দৃশ্যটি আমার দেবভোগ্য মনে হয়েছিলো।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সুখস্মৃতি ছড়িয়ে আছে বুদ্ধদেব বসুর লেখায। আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাশমহলে নানা মনোরঞ্জনী উপচারের বর্ণনা। তার মধ্যে আছে ছাত্রদের কমনরুম, যেখানে “সারি-সারি আরাম-কেদারা সাজানো, টেবিলে-টেবিলে ছড়িয়ে আছে সব সম্ভ্রান্ত বাংলা মাসিক ও ‘পাঞ্চ’ থেকে ‘রিভিয়ু অব রিভিয়ুজ’ পর্যন্ত রং-বেরঙের লণ্ডনি চালান।” আর ছিল আদিত্যর টিনের চালঅলা দর্মার ঘরে চায়ের দোকান, মনে হয় পরবর্তীকালের বিখ্যাত মধুর কেন্টিনের পূর্বসূরী সেই স্থান যেখানে ছাত্ররা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করে, আর “স্থূলবপু গুম্ফবান সুস্নিগ্ধ একটি মানুষ, আদিত্য”, ছাত্রদের কাছে প্রিয় আদিত্য-দা, “যার খাবারের দাম দেবার জন্যে পকেট হাতড়ানোর দরকার নেই, ‘লিখে রেখো’ বলাই যথেষ্ট।” কী চমৎকার মিলে যায় এই ছবিটি আমাদের চেনা, একাত্তরের শহিদ, মধুসূদন দে-র সঙ্গে। সেই বিখ্যাত মধু-দা বুদ্ধদেব বসু-র আদিত্য-দার অধঃস্তন পুরুষ কিনা তা আমার জানা নেই।
বুদ্ধদেবের মুগ্ধ স্মৃতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো সেকালের ছাত্রীদের সম্পর্কে বর্ণনা। “একমুঠো ছাত্রীও আছেন আমাদের সঙ্গে — আছেন, এবং অনেক বিষয়ে নেই। যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, পৃথক্কৃত ও সুরক্ষিত এক অতি সুকুমার উপবংশ, তাঁরা অবকাশের প্রতিটি মিনিট যাপন করেন তাঁদের পদায়িত বিশ্রাম-কক্ষে, অধ্যাপকদের নেতৃত্বে ছাড়া সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হন না। প্রতি ঘণ্টার শুরুতে এবং শেষে করিডোরগুলি বিভিন্নমুখী মিছিলে ভরে যায়: মহিলাগুচ্ছকে পশ্চাদ্বর্তী করে চলেছেন এক-একজন অধ্যাপক, পুনশ্চ নির্বিঘ্নে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের কমনরুমের দোরগোড়া পর্যন্ত। ক্লাশে তাঁদের জন্য বসার ব্যবস্থা আলাদা, আমাদের বেঞ্চিগুলো থেকে দূরে বসানো চেয়ারে: সেখানে তাঁরা চক্ষু নত রাখেন পুঁথির ওপর, কোনো প্রশ্ন করেন না অধ্যাপককে, পাঠ্যবিষয়ে হাসির কথা থাকলেও তাঁদের গাম্ভীর্যে টোল পড়ে না।” আজকের দিনে এসব কথা অবিশ্বাস্য মনে হবে, তবে আমার নিজের ছাত্রজীবনেও, একাত্তরের আগপর্যন্ত, ছাত্রীরা পৃথক বেঞ্চে বসতো; তবে অধ্যাপকদের পশ্চাদ্বর্তীনী হয়ে প্রবেশ-প্রস্থানের পশ্চাৎপদতা বোধ হয় পঞ্চাশের দশকেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বুদ্ধদেবের সময়ও ছেলে-মেয়েতে কথাবার্তা আদৌ হতো না তা নয়: দুয়েকজন ডাকাবুকো ছেলে লেডিজ কমনরুমের বেয়ারার হাতে চিরকুট পাঠিয়ে কোনো বাসন্তী সেন বা অমিতা চন্দর সঙ্গে দু-চার মিনিট অর্থহীন কথা সেরে নিতেই পারতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিকালের রূপকথার আরেকটি দৃশ্য ভেসে ওঠে আমাদের মনশ্চক্ষে: বই-খাতা হাতে বিংশতিবর্ষীয় যুবক বুদ্ধদেব চলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, পুরানা পল্টনের সেই টিনের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে, একটি রাস্তায় “যা চলে গেছে পুরানা পল্টনের মোড় থেকে পশ্চিমদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বার পর্যন্ত এক মাইল।” পাঁচ মিনিট পর মেয়েদের হস্টেল, রমনার সব সুন্দরের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সেই চামেলী হাউস থেকে বেরিয়ে এলো পাঁচটি অথবা সাতটি সহপাঠিনী। চলার গতি শ্লথ করলেন বুদ্ধদেব, যাতে অন্তত পেছন থেকে তাদের নিরীক্ষণ করা যায়। “সৈনিক অথবা খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীদের মতো শ্রেণীবদ্ধ হয়ে হাঁটছেন তাঁরা, সমতলে পা ফেলে-ফেলে — মাথা আঁচলে ঢাকা, চওড়া-পাড়ের শাদা শাড়ি পরনে, যৌবনসুলভ চাঞ্চল্যের কোনো লক্ষণ নেই, আর পা-ফেলা এমন ঢিমে লয়ের যে একটু পরেই তাঁদের অতিক্রম না করে আমার উপায় থাকে না।” আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচঞ্চল, লঘুপদবিক্ষেপে-প্রায়-নৃত্যপরা, বিদ্যার্থিনীদের দেখলে কে ভাববে একদা তাদের প্রপিতামহীরা এই বিদ্যাপিঠে কীরকম কুণ্ঠিত অস্তিত্ব ধারণ করতেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সব স্থিরছবি চিরকালের মতো সবুজ ও হৃদ্য হয়ে থাকবে বুদ্ধদেব বসু-র স্মৃতিকথায়। তাঁর জন্মবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃতী সন্তানকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবো।
লেখকঃ খোন্দকার আশরাফ হোসেন | ২৮ নভেম্বর ২০০৮
chairengdu@yahoo.com
1 মন্তব্য:
July 17, 2018 at 3:07 AM
তুলানামুলক ভাষাতত্ব বিভাগটি কলকাতা নয়, যাদবপুর বিশ্বাবিদ্যালয়ে শুরু করেছিলেন বুদ্ধদেব।
Post a Comment