১. চলতি সাময়িকপত্রে কবিতা ছাপতে দিতে আজকালকার অনেক কবিই অনিচ্ছুক−এবং এ-অনিচ্ছা অন্যায়ও নয়। কেননা অম্িনবাস্ মাসিকপত্রের পাঁচমিশালী ভিড়ের মধ্যে সত্যিকারের ভালো কবিতারও কেমন একটা বাজে ও তুচ্ছ চেহারা যেন হয়ে যায়। কবিতাকে যথোচিত গৌরবে বিশেষভাবে ছেপে থাকে এমন সাময়িকপত্র বর্তমানে দেশে বেশি নেই। অথচ আধুনিক কবিদের অনেকেই নতুন কবিতা লিখছেন−বাইরের পাঠকমন্ডলী দুরে থাক, সব সময় নিজেদের মধ্যেও সেগুলো দেখাশোনার সুবিধে হয় না। এই কারণে আমরা একটা ত্রৈমাসিক কবিতাপত্র বার করতে বাধ্য হচ্ছি। পত্রিকার নাম হবে কবিতা এবং তাতে থাকবে শুধু−কবিতা।
−বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিচিত্রা, কার্তিক ১৩৪২
২. আধুনিক কবিতা কঠিন বলেই জনপ্রিয় নয়, সহজ হলেই জনপ্রিয় হবে, এ কথা বিশ্বাস করবার তাই কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না: কেননা সুবোধ্য কবিতা যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা আসলে কবিতাই ভালোবাসেন না, কবিতার মধ্যে ইচ্ছাপূরণের উপাদান খোঁজেন মাত্র।
−বুদ্ধদেব বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা, শারদীয় সংখ্যা ১৩৪৬
কল্যাণীয়াসু,
আজ তোমার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদকী সত্তা নিয়ে একটু গল্প করি। তুমি কি বিশ্বাস করবে, তা বছর কুড়ি তো হবেই, আমার আর লিখতে ইচ্ছা হয় না। নিতান্তই সম্পাদক ও প্রকাশকদের ফরমাশে কলম চালাতে হয়। অগ্রজ কবিবন্ধু শহীদ কাদরী বলতেন, ‘আহা, কী ভালোই না হতো, যদি শুধু পড়তে পারতাম−লিখতে না-হতো!’ শহীদ কাদরী, আমার অনুজ কবিবন্ধু আবিদ আজাদের ভাষায় ‘আলস্যের সম্রাট’। আমিও আসলে কিন্তু তা-ই। বাধ্য হয়েই লেখালেখি করতে হয়, নাহলে আমিও ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াতে পারতাম, বা শুয়ে-বসে থাকতে পারতাম। তোমার অতিপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো জমিদারি থাকলে তো কথাই ছিল না।
তবে তোমার পাখির ঝাঁকের মতো চিঠি অলস আমাকে ভালো একটা পথ দেখিয়ে দিয়েছে। একটি নতুন রূপকল্পের সন্ধান দিয়েছ তুমি। নতুন রাস্তায় হাঁটার আনন্দে আলস্য ভুলে গেছি। প্রথম আলোর জাফর আহমদ রাশেদের নাড়ি-ছেঁড়া তাগাদায় সহজ উপায় বের করে ফেলেছি। এই চিঠি।
তবে কথা হচ্ছে: রানি মহলানবিশরা যেমন রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র সব গুছিয়ে রেখেছেন, তেম্িন তুমি আমার এই পত্রাবলি জমিয়ে রাখছ তো? যখন রইব না আমি মর্তকায়ায়, তখন তো শালবন-টন খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, এই পত্রাবলির মধ্যেই স্নরণ করবে আমাকে। আর শোন সব চিঠি তো এখনি ছাপা হচ্ছে না। একবার এন্ড্রুজ্ সাহেব বিদেশ থেকে ফিরলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে তাঁকে লেখা একগোছা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তেম্িন সম্পাদক-প্রকাশকদের তাগিদ একটু কমলেই আমি তোমাকে একতাড়া চিঠি দিচ্ছি সাক্ষাতেই। তা নাহলে ধারাবাহিক পত্রাবলি ছাপবে কী করে?
না, দেরি হয়ে যাচ্ছে। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। বুদ্ধদেব বসু কী না লিখেছেন?−কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, স্নৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী, ছোটদের সব রকম রচনা, প্রবন্ধ ইত্যাদি। এসবের বাইরেও পত্রিকা ও গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। এই পত্রিকা ও গ্রন্থ সম্পাদনার বিষয়েই কয়েকটি কথা লিখি। বিস্তারে নয়−সারাৎসারে। একটা স্তবকে। তবে স্তব নয়−যথাসাধ্য নিরপেক্ষতায়।
তুমি তো জানোই, এ বছর বুদ্ধদেব বসু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্নশতবার্ষিকী। বছর শেষ হয়ে এল। এঁদের নিয়ে এমন কিছু হতে দেখবে কি? কিন্তু আমরাই ১৯৯৮-৯৯ সালে নজরুল-জীবনানন্দের জন্নশতবার্ষিকী উদ্যাপন করেছিলাম অনেক বেশি প্রসারে। আরো একজনের জন্নশতবর্ষ এবার−হিমাংশু দত্ত সুরসাগর (১৯০৮-৪৪)। ইনি কে?−অসামান্য একজন সুরকার। কুমিল্লা থেকে তিরিশের দশকে যে-তিনজন গীতিকার, গায়ক ও সুরকার কলকাতায় যাওয়ায় স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম নড়ে বসেছিলেন, তাঁদের একজন। বাকি দুজন অজয় ভট্টাচার্য আর শচীনদেব বর্মণ। সময়টা তো এ রকম নয় যে সম্পাদক হয়ে লেখকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বোধ করবে−নজরুলের সঙ্গে ওঁদের তিনজনেরই সখ্য স্থাপিত হয়েছিল।
সম্পাদক হিসেবে বুদ্ধদেব কিরকম পরিগ্রাহী ছিলেন, তা বুঝবে তুমি দুএকটিমাত্র দৃষ্টান্তেই। বুদ্ধদেব-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকা নজরুল-সংখ্যায় (১৯৪৪) হিমাংশু দত্তের শোক-লিখনও ছিল।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলছিলাম, যিনি বুদ্ধদেবের একেবারে সমবয়সী। বুদ্ধদেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা মীনাক্ষী দত্ত লিখছেন, ‘এর আগে ২০২-এ মদ্যপান হয়নি কখনো। একবার শুধু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছিলাম ঈষৎ বিচলিত অবস্থায়, আমরা বাচ্চারা অবশ্য কিছু বুঝিনি, বড়দের মুখে শুনে পরে বুঝেছি। আর একদিন আমরা বাড়ি ফিরে দেখেছিলাম কুঁচকোনো সিল্কের পাঞ্জাবি পরে তিনি সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। এক সময়ে ২০২-এ প্রায়ই আসতেন তিনি। কিন্তু আমরা বড় হওয়ার পর আর দেখিনি তাঁকে।’ কবিতা-ভবন থেকে প্রকাশিত ছোটগল্প-গ্রন্থমালায় মানিকের একক পুস্তিকাও বেরিয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমসাময়িক কবিদের সম্পর্কে মানিক ছিলেন নীরব−একমাত্র বিষ্ণু দে সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, সেও ‘ড্রয়িংরুম-বিলাসী কবি’ বলে। অন্যপক্ষে বিষ্ণু দে মানিক সম্পর্কে স্িথর স্বস্থ ছিলেন চিরকালই। বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, জীবনানন্দ দাশ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ কবি−যাঁরা গল্প-উপন্যাসও লিখতেন−তাঁরা মানিক প্রসঙ্গে তাঁদের অভিমত জ্ঞাপন করেছেন। বুদ্ধদেব বসু কিছু সমালোচনা করেছিলেন সত্যি কথা, কিন্তু মানিকের মৃত্যুর পর-পরই কবিতাকেন্দ্রিত কবিতা পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। বেশ কিছুকালের পরের এক সাক্ষাৎকারে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। আমি তো পত্রিকা-পাগল মানুষ, ফলে একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর ওই সাক্ষাৎকারটি কীভাবে যেন আমার নজরে পড়ে যায়।
এতক্ষণ ধরে যে-কথা বলতে চাচ্ছি সেটা এই: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কথাশিল্পী হিসেবে, একদম আক্ষরিক অর্থেই, অসাধারণ। কিন্তু বুদ্ধদেব? গ্রহিষ্ণু সমালোচক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুকেও বলব অসাধারণ।
এই কথাও এখনই বলতে পারি: কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব কেবল তাঁর সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ কবিদেরই একত্রিত করেননি, পরবর্তী কাউকে-কাউকেও নয়, তিনি মূলত নিজেকেই পরিপূর্ণ উন্েনাচিত করতে সমর্থ হয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রধান সৃষ্টি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যেমন পরিচয় পত্রিকার, তেম্িন বুদ্ধদেব বসুও কবিতার। একটু বিস্িনত হয়েই লক্ষ করি, তিরিশের অর্থাৎ রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর কবিদের অন্তত বেশ কয়েকজন কবিকে আমরা দেখি তাঁরা সাময়িকপত্র সম্পাদনার মধ্য দিয়ে কেবল নিজেদের বিকশিত করেননি, পার্শ্ববর্তীদেরও অগ্রসরণে একটি বলয় তৈরি করেছেন। তিরিশের প্রধান কথাশিল্পীদের কিন্তু অনুরূপ কোনো ভুমিকায় দেখি না। বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব পত্রিকা ছিল মূলত প্রগতি ও কবিতা; প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছিল শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও মুরলীধর বসুর সঙ্গে কালিকলম, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে কবিতা (প্রথম বছর দুয়েক), সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে নিরুক্ত−প্রেমেন্দ্র মিত্রের স্বভাবে কোথাও একটি পথিকবৃত্তি ছিল (একটি প্রাসঙ্গিক কবিতার পঙ্ক্তি শোনো: ‘যাযাবর হাঁস নীড় বেঁধেছিল বনহংসীর প্রেমে’); সঞ্জয় ভট্টাচার্য বের করেছিলেন পূর্বাশা; এমনকি বিষ্ণু দে-রও পত্রিকা ছিল, সাহিত্যপত্র। মনে রেখো: এঁরা কেউ চাকরিয়া ছিলেন না−প্রত্যেকটি পত্রিকা ছিল ওঁদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রকাশিত অর্থাৎ ‘ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক’ (জীবনানন্দের ভাষায়) সহ্য করেই পত্রিকা বের করতে হয়েছিল ওঁদের। তার ফলেই ওঁদের ওই সাফল্য, এবং আমাকে তোমার প্রদর্শিত পথ ধরে এই পত্র রচনা করতে হচ্ছে।
বুদ্ধদেবের স্বভাব ছিল বিশুদ্ধ শিল্পীর, তাই বলে যাঁরা তাঁকে আত্মবলয়িত বলে বাতিল করতে চান তাঁরা কি যথার্থ বলেন? অন্ততপক্ষে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে বুদ্ধদেব বসু সাতটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন−বাসন্তিকা (১৯২৭-২৮, ঢাকা), প্রগতি (১৯২৭, ঢাকা), কবিতা (১৯৩৫, কলকাতা), চতুরঙ্গ বৈশাখী (১৯৪১), মধুমেলা (ছোটদের বার্ষিকী, ১৯৪২) আর Jadavpur Journal of Comparative literature (১৯৬১)। যে-তালিকাটি তোমাকে বলছি, সেটি সমীর সেনগুপ্তের প্রণয়ন। কিন্তু সমীর সেনগুপ্ত লিখছেন বৈশাখী প্রসঙ্গে, বাংলা সাহিত্যের প্রথম বার্ষিকী এটি। এ কথা তিনি বুদ্ধদেব-জীবনীতেও জানিয়েছেন। তিনি ওয়াকিফহাল নন যে তিরিশের দশকে জাহান-আরা চৌধুরী বর্ষবাণী নামে একটি বার্ষিকী প্রকাশ করেছিলেন, অত্যুৎকৃষ্ট সেই বার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-নজরুল তো লিখতেনই−বুদ্ধদেব বসুও লিখেছেন। তিরিশের দশকেই হবীবুল্লাহ বাহার-নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ানরা প্রাতিকা নামে আরেকটি বার্ষিকী বের করেছিলেন। একটি সংখ্যাই বেরিয়েছিল প্রাতিকার কিন্তু বর্ষবাণী অনেক দিন ধরে অনিয়মিতভাবে বের করে গিয়েছিলেন জাহান-আরা চৌধুরী আর তাঁর ভ্রাতা আলতাফ চৌধুরী। আরো কোনো বার্ষিকী বেরিয়েছিল কি না, তা অনুসন্ধেয়। সাহিত্যে চট্ করে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া ঠিক না।
অনেক বছর আগে একটি প্রাচীন লাইব্রেরিতে বৈশাখী বার্ষিকী দেখেছিলাম−খুব সমৃদ্ধ। যেমন বর্ষবাণী ও প্রাতিকাও নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ। কবিতা পত্রিকার নির্বাচিত রচনার চয়নিকা বেরিয়েছে আগে তিন খন্ডে, এখন বুদ্ধদেব বসুর জন্নশতবর্ষে নতুন করে বেরোচ্ছে ফের। তেমনি প্রগতি ও বৈশাখী বার্ষিকীর অন্তত নির্বাচিত দুটি সংগ্রহ বের হওয়া উচিত।
এই যে পত্রিকা প্রসঙ্গে ‘উৎকৃষ্ট’, ‘অত্যুৎকৃষ্ট’, ‘সমৃদ্ধ’ শব্দগুলি ব্যবহার করছি, কেন করছি। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন খারাপ কবিতা থেকে ভালো কবিতা আলাদা করে নেওয়ার কথা, তেম্িন ঊনমান পত্রিকা থেকে মানসম্পন্ন পত্রিকা চিনে নিতে হবে তোমাদের। অন্তর্বস্তুই আসল। তারপর ছাপা-বাঁধাইয়ের সৌকর্য। দ্বিতীয়টি না-থাকলেও কোনো এসে যায় না।
কবিতায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত।’ লিখে ছিলেন ‘জানালার পর্দা টেনে দে।’ এটা দিয়েই বুদ্ধদেবকে বিচার করা যাবে? পত্রিকার মধ্য দিয়েই তিনি যে-সামাজিক কাজ করেছেন, তা স্বঘোষিত সমাজচেতন কতজন লেখকের দ্বারা সাধিত হয়েছে।
বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত-সম্পাদিত প্রগতি পত্রিকা অথবা বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অন্যদের দ্বারা সম্পাদিত কবিতা পত্রিকা−যাঁর নামই ছাপার হরফে থাকুক, বুদ্ধদেব বসুই ছিলেন কেন্দ্রব্যক্তিত্ব। তাঁর লেখকসত্তা আর সম্পাদকসত্তার মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। প্রতিভা বসুর সম্পাদক-নামাঙ্কিত পত্রিকাগুলির আসলে বুদ্ধদেব বসুই সম্পাদক ছিলেন, এ তো বোঝাই যায়।
বুদ্ধদেব বসুর উন্েনষ ঢাকায়, বিকাশ কলকাতায়। জীবনানন্দের মতো কলকাতা নিয়ে দোলাচল ছিল না তাঁর। বুদ্ধদেব বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেই কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন, ১৯৩১ সালে, তাঁর উদ্দেশ্য পরিষ্ককার: সাহিত্যজগতের কেন্দ্র তখন কলকাতা, পুরোপুরি সাহিত্যে সমর্পিত হলেন। বুদ্ধদেব বসুকেও জীবনসংগ্রাম কম করতে হয়নি, জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত করতে হয়েছে। দ্বিধাপীড়িত জীবনানন্দ কলকাতায় গিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে, দেশবিভাগের আগে, আতঙ্কে, বি. এম. কলেজের চাকরি বহাল রেখে। বুদ্ধদেব তাও কিছুটা জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন, জীবনানন্দের দুর্গতির শেষ ছিল না। এটা বাস্তব তথ্য হিসেবে একেবারে অস্বীকার করা যাবে না যে, পশ্চিম বাংলা-নিবাসী সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে-প্রেমেন্দ্র মিত্র-অমিয় চক্রবর্তী-সমর সেনের আর পূর্ব বাংলা থেকে আগত বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশের অবস্থানে কোথাও-একটু ভিন্নতা ছিল।
কিন্তু ঢাকা বা বরিশাল থেকেই বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ ‘অতি-আধুনিক’ বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। অতি-আধুনিক সাহিত্যের তিনটি বাহনের দুটি বেরিয়ে ছিল কলকাতা থেকে−কল্লোল (১৯২৩) ও কালিকলম (১৯২৬), তৃতীয়টি ঢাকা থেকে প্রগতি (১৯২৭)। প্রগতি প্রথমে ছিল হাতে-লেখা (জানো, আমাদের সময়েও ঢাকায় হাতে-লেখা পত্রিকার চল্ ছিল, এমনকি আমরাও বের করেছি), তা থেকেই বুঝতে পারো: বুদ্ধদেব বসু কেবল আত্মবৃত্তের অধিবাসী ছিলেন না।
প্রগতি পত্রিকায় বুদ্ধদেব জড়ো করেছিলেন যেমন অগ্রজ মোহিতলাল ও নজরুলকে, তেম্িন তাঁর সমসাময়িক নবীন লেখকদের। তখনই তৈরি হয়ে যায় এই ত্রয়ী নায়ক−প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত আর বুদ্ধদেব বসু। তখন থেকেই বুদ্ধদেবের নেতৃত্বেই মূলত আধুনিকতার আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। শনিবারের চিঠিও একই সময়ে বেরোতে থাকে−এবং আধুনিকতার জেহাদ ঘোষিত হতে থাকে। অজিত দত্ত, অমলেন্দু বসু, জীবনানন্দ দাশ−এঁরা সব একত্রিত হয়েছিলেন ঢাকাতেই। পরে তো এঁরা কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হন সকলেই। বুদ্ধদেবের প্রগতি পত্রিকায় কেবল জীবনানন্দের কবিতাই ছাপা হতো না, জীবনানন্দকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে বুদ্ধদেব তখনই লড়াই শুরু করেছিলেন−এবং তাঁর নির্বাচন-যে নির্ভুল ছিল তা আজ প্রগতি প্রকাশের ৮০ বছর পরে বলবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু একা জীবনানন্দকে আবিষ্ককার করেছিলেন বুদ্ধদেব?−কবিতা পত্রিকা যখন ক্রমপরিণত হচ্ছে, বুদ্ধদেবও তখন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিলেন।
তার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। এই চিঠির শীর্ষে যে-দুটি উক্তি উদ্ধৃত করেছি, বুদ্ধদেব বসুর ৬০তম জন্নবার্ষিকীতে জ্যোতির্ময় দত্ত-সম্পাদিত কলকাতা পত্রিকার বুদ্ধদেব বসু-সংখ্যায় উদ্ধৃত হয়েছিল এগুলি। দেখেছ তো, ভালো পত্রিকা মানে শুধু কয়েকটি লেখা সংগ্রহ নয়। ভালো সম্পাদক রচনা-সংগ্রাহক নন।
প্রগতি পত্রিকার প্রথম বর্ষে প্রকাশিত বুদ্ধদেবের একটি প্রবন্ধের (‘বঙ্গ সাহিত্য’) এই উক্তিটিও এই লেখার ওপরে স্থাপন করা যেতো অনায়াসে−প্রায় ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে: ‘এই অতি-আধুনিকদের ভিতর থেকে কেউ কেউ উত্তরকালে যে বাংলার কলালক্ষ্মীকে নব-আভরণে অলংকৃত করবেন, একথা তাঁরা মনে মনে বোঝেন না, এরূপ ইঙ্গিত করে তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তির অবমাননা করব না। সেই জন্যই বোধহয় তাঁদের অন্তরে এত জ্বালা, অপমান করবার আকাঙ্ক্ষা এমন অপরিমেয়।’
প্রগতি পত্রিকায় বুদ্ধদেব ও তাঁর বন্ধুরা ‘অতি-আধুনিক’ সাহিত্যের সপক্ষেই ছিলেন না কেবল, নিজেরাও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। বুদ্ধদেব তখন থেকেই বিচিত্রবিহারী। শনিবারের চিঠি নজরুলের বিপক্ষে অবিশ্রাম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে গেছে। বুদ্ধদেব প্রগতি পত্রিকায় লিখছেন, ‘ব্যঙ্গ ও কটুক্তি করবার জন্যই তাঁরা উন্নুখ, তাই অনিন্দনীয় যে কিছু থাকতে পারে, একথা তাঁরা আমলেই আনতে চান না। নইলে নজরুল ইসলামের গজল-গানগুলির প্যারডি করতে নিশ্চয়ই তাদের হাত কাঁপতো।’
হ্যাঁ, কবিতা পত্রিকার কথা বলছিলাম তোমাকে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল−দুজনই বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান। এঁরা এত বড় যে সাধনা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রধান নন শুধু−একমাত্র; তেমনি ধুমকেতু পত্রিকায় নজরুল ইসলামই সবটুকু জুড়ে আছেন। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে প্রমথ চৌধুরী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা বুদ্ধদেব তেমন নন−এঁদের ঘিরে অন্যরাও বিকশিত-গুঞ্জরিত হয়েছে। কবিতা পত্রিকায় সর্বাধিক লিখেছেন বুদ্ধদেব, কিন্তু তিনি ওই পত্রিকায় জীবনানন্দকে প্রতিষ্ঠা দেননি? একা কেবল জীবনানন্দকেই?−আমরা অনেক সময় ভুলে যাই: অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন, বিষ্ণু দে−পুরো আধুনিক কবিগোষ্ঠীকে তিনি সংহত করে এনেছিলেন একটি বৃত্তে। বুদ্ধদেব ছাড়া আমরা কি পেতাম অজিত দত্তের সেই অসামান্য কবিতাটি−‘মালতী, তোমার মন নদীর স্রোতের মতো চঞ্চল উদ্দাম...’, যা শুনে তুমি রীতিমতো পরিপ্লুত হয়েছিলে। অসম্পুর্ণ ছিল কবিতাটি; কিন্তু বুদ্ধদেব জোর করে অজিত দত্তের কাছ থেকে কবিতাটি না-নিয়ে এলে আমরা কি ওই হিরের টুকরোটি পেতাম! হেমচন্দ্র বাগচী বা নিশিকান্ত (রায় চৌধুরী) কোথায় হারিয়ে যেতেন। এমনকি অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া। চল্লিশের বাম-ডান দুই পক্ষকেই। এমনকি পঞ্চাশের কবিদেরও কারো কারো। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক নিয়ে দীর্ঘ সমালোচনা লিখেছিলেন, সবাই জানি। কিন্তু মণীন্দ্র রায়ের এত কবিতা ছেপেছিলেন−কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখার তালিকা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। অশোক মিত্র দুঃখ করেছেন বা আত্মপ্রশংসাই বলা চলে, করেছেন কলকাতা পত্রিকার ওই বুদ্ধদেব-সংখ্যায় এই বলে যে তাঁরা তিরিশের কবিদের নিয়েই মত্ত থেকেছেন, নিজেদের কথা বলেননি। কেন বলেননি? তিনি তো তাঁর বাম মতাদর্শের বা তাঁর দক্ষিণপন্থী বন্ধুদেরই নিয়ে একটি পত্রিকা বের করতে পারতেন−তাঁর তদানীন্তন রচনায় বুদ্ধদেবকে কটাক্ষ না-হেনে।
তবে, এটা তো মিথ্যে নয়, অন্যদের যত আশ্রয়-প্রশ্রয় দিন, কবিতা পত্রিকার কেন্দ্রে ছিলেন তিরিশের কবিরা। কিন্তু কোন্ পত্রিকা তা নয়? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পঞ্চাশ বছরের বেশিদিন ধরে কৃত্তিবাস বের করে যাচ্ছেন, অতি তরুণ কবিরাও সেখানে পরিগৃহীত হয়েছেন, কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি সংখ্যায়ও দেখলাম রাজত্বে সেই পঞ্চাশের কবিরা। আমাদের বন্ধু ইমরুল চৌধুরী এই তো কিছুকাল আগে কালের যাত্রা নামে একটি পত্রিকা বের করেছিল, তারও তো মুখ্য কুশীলব ছিলাম আমরাই। কিন্তু তার মধ্যেও বুদ্ধদেব অন্যদের কোথায় ছাড়িয়ে গেছেন, দ্যাখো। বুদ্ধদেব তাঁর কবিতা পত্রিকার শতাধিক সংখ্যার মধ্যে বাঙালি কবিদের নিয়ে চারটি বিশেষ সংখ্যা করেছিলেন−রবীন্দ্র-সংখ্যা (জীবনের একেবারে উপান্তে এসে যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ আনন্দিত হয়েছিলেন), নজরুল-সংখ্যা (নজরুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ার পরে-পরেই), জীবনানন্দ-সংখ্যা আর সুধীন্দ্রনাথ-সংখ্যা। আমার বিবেচনায়, কবি ও লেখক নির্বাচনে বুদ্ধদেবের একতিল ভুল হয়নি। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ তিনজন কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ। আর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে আমার ধারণা: তিনি তাঁর প্রাপ্য আদৌ পাননি। দুঃখের বিষয়, ইতিহাসজ্ঞানের অভাবে ইদানীং বাংলাদেশে তিরিশের কবিদের (এক জীবনানন্দ ব্যতিরেকে) বৈদেশিকী বলে খারিজ করবার একটি ঢেউ উঠেছে। এসব পরোক্ষে তাঁদের শক্তিমত্তারই পরিচায়ক বলে বোধহয় দরকার পড়ছে। বৃথা বলে মনে করি।
পুঁথি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সেকালের ভাষায় বললাম। ৭২ বছর বয়সে তোমাদের ভাষা আয়ত্ত করতে পারব না আর।
বুদ্ধদেব কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন। তার মধ্যে অত্যুত্তম আধুনিক বাংলা কবিতা। রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেছিলেন বাংলা কাব্য-পরিচয়, সুর্যকলঙ্ক, সে-বই প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে দীর্ঘ রিভিয়্যু লিখেছিলেন বুদ্ধদেব কবিতা পত্রিকায়। এবং তারই প্রতিবাদে আবু সায়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন কবিতা-ভবন থেকেই আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৪০)। সেটিও বুদ্ধদেবের পছন্দ হলো না। তাই হীরেন্দ্রনাথকে একবারও না-জানিয়ে, হীরেন বাবু তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন, নিজে সম্পাদনা করলেন আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৫৪)। সে-বইয়ের প্রথম সংস্করণে দেখবে মোহিতলালের কবিতা সবশেষে। আর আধুনিক বাংলা কবিতার বুদ্ধদেবের জীবৎকালে প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণ অর্থাৎ পঞ্চম সংস্করণে কথাশিল্পী সন্তোষকুমার ঘোষের রচনাও গৃহীত হয়েছে। স্বপন মজুমদারের ভাষায়, ‘চন্দ্রকলঙ্ক’।
এর উত্তরে তোমার একটি প্রশ্নমালা সমেত চিঠি না পাঠিয়ে, যাতে আমার সুর্যকলঙ্ক বা চন্দ্রকলঙ্ক ঘটে বা রটে, সেরকম চিঠিই পাঠাও বরং।
তোমার কবিশিল্পী/১১ অঘ্রান ১৪১৫
লেখকঃ আবদুল মান্নান সৈয়দ
0 মন্তব্য:
Post a Comment