রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তাঁর জন্ন ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর। বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যচর্চার উন্েনষকালটা কেটেছে ঢাকার ৪৭ পুরানা পল্টনে। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে ঢাকার তোষিণী পত্রিকায়। তিনি বিখ্যাত প্রগতি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন পুরানা পল্টনের বাড়ি থেকে। এখান থেকেই তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল প্রগতি সাহিত্যগোষ্ঠী। আজ বুদ্ধদেব বসুর জন্নশতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাঁর পুরানা পল্টনের জীবন ও বসতবাড়ির বর্তমান অবস্থা নিয়ে লিখেছেন আপেল মাহমুদ।
হোল্ডিং নম্বর ৪৭ এখনো অবিকৃত রয়ে গেছে। দুই বিঘা জমির ওপর গড়ে-ওঠা লাল ইট আর চুন-সুরকির দেয়ালটানা টিনের ছাদ দেওয়া কোঠাবাড়িটি কেবল সংস্কার করা হয়েছে। তবে মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছে দুইবার। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮−১৯৭৪) পল্টন জীবনের স্নৃতিকথায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে বাড়িটির কথা। তিনি নিজের মুখেই বলেছিলেন, ‘আজ যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কোন জায়গা, আমি অনায়াসে উত্তর দিই, পুরানা পল্টন।’
বুদ্ধদেব বসুর জন্ন কুমিল্লায় হলেও কলকাতা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকায় তাঁর জীবন কেটেছে সাড়ে নয় বছর (১৯২২−১৯৩১)। এর মধ্যে ছয় বছর কেটেছে পল্টনের এ বাড়িতে। এ বাড়ি থেকে তিনি প্রকাশ করেছিলেন প্রগতি পত্রিকা। এ পত্রিকা ঘিরে গড়ে উঠেছিল ঢাকার আলোচিত ‘প্রগতি সাহিত্যগোষ্ঠী’। ঢাকার প্রগতি গোষ্ঠী ছিল কলকাতার কল্লোল গোষ্ঠীর সহযোগী দল। ১৩ বছর বয়সে নোয়াখালী ছেড়ে বুদ্ধদেব বসু ঢাকা এসেছিলেন মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহের হাত ধরে। প্রথমে থাকতেন ওয়ারীর ২৩ র্যাংকিন স্ট্রিটে। ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. ভবতোষ দত্তের স্নৃতিচারণা থেকে জানা যায়, সময়টা ১৯২২−২৩ সাল হবে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে চিন্তাহরণ সিংহ এসেছেন, র্যাংকিন স্ট্রিটের উত্তর প্রান্তের একটি বাড়িতে, সঙ্গে এসেছেন তাঁর দৌহিত্র বুদ্ধদেব বসু। অল্প বয়সে মাতৃহীন, দাদুর কাছেই থাকেন। ওয়ারীতে থাকা অবস্থায় বুদ্ধদেব বসু পতাকা নামে হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের করতেন। মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহের মৃত্যুর পর মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহের প্রচেষ্টায় পল্টনের প্লটে বাড়ি করে সেখানে তারা চলে আসেন ১৯২৫ সালের দিকে।
১৮৪০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনানিবাস ছিল যেখানে, তা পরবর্তীকালে পল্টন এলাকায় পরিণত হয়। বুদ্ধদেব বসুরা বাড়ি নির্মাণ করার সময় পল্টনে সবে জনবসতি শুরু হয়েছে। তাঁর স্নৃতিকথা থেকে জানা যায়, ‘সতেরো বছর বয়সে আমি পুরানা পল্টনের বাড়িতে আসি। পাড়াটা তখন সবে গড়ে উঠছে; শহরের এক প্রান্তে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দু-একখানা বাড়ি; পাকা রাস্তা নেই, ইলেকট্রিসিটি নেই; সে-ই বড় রাস্তার মোড়ে একমাত্র জলের কল। ডাকবাংলোর পর থেকে রাস্তাতেও আলো ছিল না।’
কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক খাঁ বাহাদুর তসদ্দক আহমেদের প্রিয় ছাত্র বুদ্ধদেব বসু অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তাঁর বাংলা ও ইংরেজি খাতা দেখে প্রধান শিক্ষক অভিভুত হয়ে পড়েন। এ ধারা ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও অক্ষত ছিল। ১৯২৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তিসহ দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন বুদ্ধদেব বসু। একই বছরের জুলাই মাসে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধাবী বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে কবি শামসুর রাহমান উল্লেখ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের তুখোড় ছাত্র ছিলেন। তাঁর পরীক্ষার খাতা দেখে একজন ইংরেজ অধ্যাপক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ছেলেটি হয় প্রতিভাবান, নয় তো উন্নাদ।’ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বুদ্ধদেব বসু ছাত্রসংসদ পরিচালিত সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ও জগন্নাথ হল বার্ষিকী বাসন্তিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন কলেজজীবনের হাতে লেখা পত্রিকা প্রগতি ছাপার অক্ষরে রূপান্তর করার সুযোগ পান তিনি। বৃত্তির কুড়ি টাকা যোগ করে ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টন থেকে প্রগতির প্রথম সংখ্যা বের হয় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে। সম্পাদক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে যোগ হলো শ্রী অজিত কুমার দত্তের নাম।
প্রগতির সঙ্গী হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ড. মোহিতলাল মজুমদার, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, পরিমল রায়, অমলেন্দু বসু, মনীশ ঘটক, সুধীশ ঘটক, অনিল ভট্টাচার্য, ভৃগু গুহঠাকুরতা, পঙ্কজকুমার দাশগুপ্ত, সুধাংশু দাশগুপ্ত, গায়ত্রী দেবী ও সমরেন্দ্র গুপ্তসহ আরও অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক (১৯২৯ সালে) সংখ্যা ছিল প্রগতির শেষ প্রকাশনা। ১৯৩৪ সালে কলকাতা রিপন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর ঢাকা জীবনের ইতি ঘটে। কিন্তু ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনে তাঁর ছয় বছরের অনেক স্নৃতি রয়ে যায়।
বুদ্ধদেব বসু কলকাতা চলে যাওয়ার পরপর বাড়িটির মালিকানা পরিবর্তন হয়ে যায়। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর সেরেস্তাদার দুর্গাপ্রসন্ন সেনগুপ্তের ছেলে বগলাপ্রসন্ন সেনগুপ্ত বাড়িটি কিনে নেন। বগলাপ্রসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষক ও কিছুদিন রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বাড়ির নতুন নামকরণ করেন ‘গোলাপবাগ লজ’। এ বাড়িতে জন্েনছিলেন বিখ্যাত কবি ও বিভাব পত্রিকার কর্ণধার সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। তিনি ছিলেন বগলাপ্রসন্নের ছেলে। এক বচন বহুবচন গ্রন্েথ তিনি তাঁর পল্টন জীবনের বিস্তৃত স্নৃতি লিপিবদ্ধ করেছেন।
১৯৫১ সালের দিকে সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের পরিবার ঢাকা ছেড়ে কলকাতা চলে যায়। সংগত কারণে ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের মালিকানা পুনরায় পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন কলকাতা লেকসার্কাস এলাকার ৬ নম্বর, সার্কাস মার্কেট প্যালেসে বসবাস করতেন হাবিবুর রহমান। তিনি সপরিবারে ঢাকা চলে আসার চিন্তাভাবনা করছিলেন। অবশেষে ১৯৫৯ সালে ৬ নম্বর সার্কাস মার্কেটের ছয় কাঠা বাড়ির সঙ্গে ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের দুই বিঘা বাড়ির বিনিময় দলিল সম্পন্ন হয়। হাবিবুর রহমান কোঠাবাড়ির সব কাঠামো ঠিক রেখে শুধু বাড়ির নাম ‘গোলাপবাগ লজ’ থেকে ‘পল্টন গার্ডেন’ নামে পরিবর্তন করেন। তিনি ছিলেন ছাপাখানার মালিক। ৯ নম্বর হাটখোলা রোডে তাঁর ছিল বিখ্যাত প্যারামাউন্ট প্রেস, যা থেকে ইত্তেফাক, মাহে নও, নওরোজ, ব্রিটিশ ও মার্কিন পরিক্রমা ছাড়াও সরকারি গেজেট, দলিল-দস্তাবেজ ছাপা হতো।
হাবিবুর রহমানের ছেলে আমিনুর রহমান জানান, তাঁরা প্রতিনিয়ত ভবন-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আর্থিক প্রলোভন পাচ্ছেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত ও হাবিবুর রহমানের স্নৃতিবিজড়িত কোঠাবাড়ি, বাগান ও গাছগাছালি কোনোটাই হারিয়ে ফেলতে চান না। এ জন্য বাড়িটি যাতে ধসে না পড়ে, তার জন্য সময় সময় প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থল ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের বাড়িতে বসবাস করতে পেরে হাবিবুর রহমানের পরিবার ধন্য বলে তাঁরা জানান।
হাবিবুর রহমানের স্ত্রী আমিনা রহমান বলেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে মীনাক্ষী বসু (বিয়ের পরে দত্ত) ও বগলাপ্রসন্ন সেনগুপ্তের ছেলে সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত এ বাড়িতে এসেছেন। তাঁরা বিভিন্নভাবে পুরোনো স্নৃতি হাতড়ে বেড়াতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এ দৃশ্য বড় কষ্টদায়ক। সময় ও পরিস্িথতির কারণে হয়তো তাঁদের বাপ-দাদার ভিটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, তাঁর জন্ম হয়েছিল যে কক্ষে, সেখানে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন, কোথায় বসে তাঁর বাবা পড়াশোনা করতেন, কোন কক্ষে ছিল প্রগতি পত্রিকার কার্যালয়।’
৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের উত্তরাংশে বাস করেন খ্যাতনামা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। তিনি বাড়ির মালিক হাবিবুর রহমানের মেয়েজামাই। তিনি যে অংশে ভবন নির্মাণ করেছেন, তার হোল্ডিং হয়েছে ৪৭/১ নম্বর। বাড়ির নাম রাখা হয়েছে সুবর্ণা। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়, বুদ্ধদেব বসু যে বাড়িতে বসবাস করেছেন, সেখানে আমি থাকছি।’ তিনি আদি কোঠাবাড়িটি অক্ষত রেখে বুদ্ধদেব বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পক্ষে মতামত দেন। তিনি বলেন, ‘পুরানা পল্টন ছিল অভিজাতদের পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। রমনার পরেই পল্টনের অবস্থান ছিল। বুদ্ধদেব বসুর লাগোয়া ৪৬ নম্বরের বাড়িটি ছিল আরেক খ্যাতনামা লেখক কাজী আব্দুল ওদুদের বাসভবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্ত, গায়ক আব্বাসউদ্দীন, শিকারকাহিনী লেখক হীরালাল দাশগুপ্ত, ব্রিটানিয়া সিনেমা হলের মালিক শ্রী পাঠক ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. রেফাতুল্লাহ ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর প্রতিবেশী।’
পল্টনের বাড়িতে বুদ্ধদেব বসুর একটি উল্লেখযোগ্য স্নৃতি ছিল বর্ষার রূপ। টিনের ঘরের বারান্দায় বসে তিনি বর্ষার অপরূপ দৃশ্য দেখতেন। তিনি স্নৃতিকথায় লিখেছেন, ‘অমন ধ্বনিবর্ণবহুল, উচ্ছৃঙ্খল, অজস্র বর্ষা আর দেখতে পাব না। কী ঘন সমারোহেই না বর্ষা নামত সেই নির্জন বিস্তীর্ণ প্রান্তরে!...কিন্তু এও জানি, সে আনন্দ আর কখনো পাব না, পুরানা পল্টনের টিনের বাড়িতে যা পেয়েছিলাম।’
লেখকঃ আপেল মাহমুদ । প্রথম আলো । ৩০ নভেম্বর ২০০৮
0 মন্তব্য:
Post a Comment