.............
বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ - ১৯৭৪)
.............
…কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনে; কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো’ যাবে না।
– ‘কবিতার দুর্বোধ্যতা’: বুদ্ধদেব বসু
কল্যাণীয়াসু,
গতকাল রাতে একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪)-র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সাক্ষাৎকার দিলাম। সাক্ষাৎকার নিল অনুজোপম মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। দশ মিনিটের সাক্ষাৎকারে কী আর বলা যায়। কিন্তু জাহাঙ্গীরের প্রশ্নমালা আমার ভেতরে যে-জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছে, সেটাই একটু বিশদ বলি তোমাকে।
প্রথম প্রশ্ন ছিল বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য কোথায়। এই একটি প্রশ্নের জবাবে যা বলা যায়, তারই মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর সারসত্তা ছেঁকে তুলে নেওয়া যায়। — কবি হিশেবে বুদ্ধদেব বসুকে আমি জীবনানন্দ দাশের মতো তাঁর কালের মহত্তম কবি বলব না, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে’র মতো অসাধারণও তিনি নন। তারপরেও বুদ্ধদেব বসুকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্র নজরুলোত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আলোচনা কি আমরা করতে পারি?
.................
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, কন্যা মীনাক্ষী, প্রতিভা বসু, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
................
পারি না। কেন পারি না? এ জন্যে যে, রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার তথা সাহিত্যের পৌরোহিত্য করেছিলেন তিনি। ঠিক এরকম নায়কত্ব বাংলা সাহিত্যে দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কালে। বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য এঁদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বরং তাঁর সাহিত্য-সংবেদন-ও-গ্রহিষ্ণুতার সঙ্গে তুলনীয় আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের কবি-সমালোচক এজরা পাউন্ড অথবা আধুনিক ফরাসি সাহিত্যের কবি-সমালোচক গিওম আপোলিনেয়ার। কবি ছিলেন আপোলিনেয়ার। কিন্তু আশ্চর্য, তিনি পাবলো পিকাসোরও প্রথম দিকের আবিষ্কর্তা সমালোচকদের একজন। টি. এস. এলিয়টের কবিতাকে কাটাকুটি করে পাউন্ডই তো তাঁর বিশ্বপরিব্যপ্ত পরিচায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফরাসি সাহিত্যের এক ইতিহাসে আমি দেখেছিলাম কবি হিসেবে আপোলিনেয়ারকে একবারে নসাৎ করে দিতে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা নিয়ে অন্যদের কথা কী বলব, আমি নিজেই ঠিক মনস্থির করতে পারি না। একেক সময় ভাবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা কাঁচা, বানানো, কৃত্রিম। আবার একেক সময় মনে হয় কবিতা তো অনেক রকম। বুদ্ধদেবের কাঁচা রোমান্টিকতাও কি ভুলে যেতে পারি? ‘একটু সময় হবে — কাছে গিয়ে বসিব তোমার?’ এ রকম লাইন তো আজো মনেই শুধু বিঁধে নেই, মাঝে মাঝে মুখে উচ্চারণ করতেও হয়। ‘একখানি হাত’-এর মতো কবিতা কখনো কি আমূল নাড়িয়ে দেয় না আমাদের? কিছুকাল আগে আমাকে একজন শুনিয়েছিলেন, ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত।’ এই যে সব কবিতা বা কবিতার পঙ্ক্তি আজো আমাদের মনে উড়ছে, মুখে উড়ছে, এই তো কবিতার তাবৎ তত্ত্বকথাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ রকম আরো অনেক কবিতা বা কবিতার পঙ্ক্তি কাব্যপাঠক আমরা বিস্মৃত হবো না কখনো। জীবনানন্দ দাস তো বটেই, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দেও যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধদেবের প্রথম কবিতাগ্রন্থ মর্মবাণী থেকে কবির জীবৎকালে প্রকাশিত সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থ স্বাগত বিদায় পর্যন্ত এক বিরাট পরিক্রমা। এখানে একটু আলাদা করে বিষয়টা তোমাকে বুঝিয়ে বলি।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আর বুদ্ধদেব বসু — এই তিনজন ছিলেন ‘কল্লোল’ যুগের তিন নায়ক। কল্লোল(প্রথম প্রকাশ: ১৯২৩), কালিকলম (প্র: প্র: ১৯২৬) ও প্রগতি (প্র. প্র. ১৯২৭) এই তিনটি প্রত্রিকা ছিল আধুনিকতার প্রথম মুখপাত্র। কল্লোল ও কালিকলম বেরিয়েছিল কলকাতা থেকে, আর প্রগতি প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে। আশ্চর্য কিংবা একান্ত স্বাভাবিক, যে, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আধুনিকতার মুখপত্র এই তিনটি সাময়িকপত্রেরই প্রধান লেখক। একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, এখন যখন নজরুল ইসলামকে কেউ কেউ খারিজ করতে চান আধুনিকতার খাতা থেকে তারা দয়া করে ঐ তিনটি পত্রিকার পুরোনো পৃষ্ঠা একটু উলটিয়ে দেখবেন।
মূল প্রসঙ্গে আসি। প্রগতি পত্রিকা বুদ্ধদেব বসু আর অজিত দত্ত যুগ্মভাবে সম্পাদনা করতেন। প্রগতি পত্রিকাতেই আধুনিকতার একটি বীজধানভূমি প্রস্তুত হয়েছিল — যার মধ্যে রবীন্দ্রদ্রোহিতা ছিল। তাকেও ক্ষমাশীল দৃষ্টিতেই দেখতে হবে বলে মনে করি। কেননা কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি এবং সেকালের আরো কিছু পত্রিকার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রবিধর্মী সাহিত্যের সূচনা হয়। দরকার ছিল ওই দ্রোহের। আজকাল কেউ কেউ এদের ইউরোপীয়ানা বলে নাকচ করবার চেষ্টা করছেন, অতীতেও তা হয়েছে। তাঁরা ভুলে যান সমগ্র আধুনিক বাংলা সাহিত্যকেই তাহলে বাতিল করে দিতে হয়। মধ্যযু থেকে বাংলা সাহিত্য তো বেরিয়ে এল কবিতাকে অচ্যূত রেখে গদ্যের সমতলে নেমে এসেই। গদ্যে যতিচিহ্ন বিদ্যাসাগর আনলেন কোত্থেকে? মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্য আর সনেট লিখলেন কোন দুঃখে? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন? নাটক ও প্রহসনই বা দীনবন্ধু মিত্র ও অন্যেরা লিখতে গেলেন কী আনন্দে?
হ্যাঁ, প্রগতি-র কথা বলছিলাম।
বুদ্ধদেব বসুর বন্ধুমণ্ডলীতে তখন এবং তারপরও অনেকদিন ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অজিত দত্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। মনে রেখো, যা আমরা অনেকেই ভুলে যাই সেটা হচ্ছে, কবিতা পত্রিকার প্রথম দু’বছর বুদ্ধদেব বসু আর প্রেমেন্দ্র মিত্র যুগ্মভাবে সম্পাদক ছিলেন। প্রগতি বরাবর বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত যুগ্মভাবে সম্পাদনা করে গেছেন। বুদ্ধদেবের এই যে বন্ধুমহল, এঁরা ছিলেন উত্তাল রোম্যান্টিক ও হৃদয়বাদী। ১৯৩৫ সালে কবিতা পত্রিকা যখন বেরোল, তখনও বুদ্ধদেব ঐ হৃদয়বাদী বন্ধুদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব অন্তঃপরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিলেন। বিষ্ণু দে-র কথা এখানে বলিনি তোমাকে। বিষ্ণ দে প্রগতি পত্রিকার লেখক ছিলেন তো বটেই, কবিতাতেও লিখেছেন। তাঁর মধ্যে বরাবরই হৃদয় ও মননের একটি আশ্চর্য মিশ্রণ ও দ্বন্ধ ছিল। এও মনে রেখো, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। ওরকম মননজীব সাহিত্যপত্র বাংলা ভাষায় হয়নি আর। অথবা প্রথম চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র (প্র. প্র. ১৯১৪) কে পরিচয়-এর পূর্বসূরী বলা যায়। তবে পরিচয়-এর পরিব্যপ্তি ছিল অনেক বেশি। প্রকৃতপক্ষে, পরিচয় পত্রিকাই বাংলা কবিতার মননভূমি প্রস্তুত করে দেয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ বাংলা কবিতায় মননের আরাধনা করে সমগ্র বাংলা কবিতাতেই সম্পূর্ণ একটি নতুন আয়তন যুক্ত করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ নিজে উল্লেখ করেছেন এক সন্ধ্যা তিনি ‘উড়ে চলে গেছে’ কথা ক’টি ‘উড্ডীন’ শব্দে রূপান্তরিত করার জন্যে ব্যয় করেছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভালোবেসে র্ভৎসনা করেছিলেন। ‘রবীন-ধুত্তোর’ (কথাটি তোমার অতি প্রিয় গুরুদেব রবীন্দনাথ ঠাকুরের স্বকৃত ‘রবীন্দ্রোত্তর’ শব্দের লালিকা বা প্যারোডি) হৃদয়বাদী কবিতার বিরুদ্ধে মননশীল কবির ওই পরিশ্রম প্রয়োজন ছিল। এ কালের দৃষ্টিতে ওকে বিদেশিয়ানা বলে খারিজ করলে ইতিহাসজ্ঞানের অভাবই প্রমাণ করে। পরম্পরা বা ধারাবাহিকতা ব্যতিরেকে মানুষ কেন, কোনো ইতিহাসই রচিত হতে পারে না — এ তো তুমি প্রায়শ বলো।
চিঠি লেখার এই মুশকিল। এক কথা থেকে অন্য কথায় চলে যায়। অথচ তুমিই আমাকে দিনের পর দিন প্ররোচনা দিয়েছ পত্রসাহিত্য রচনা করবার জন্যে। এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের হাজার দশেক চিঠিকে অতিক্রম করা এই বয়েসে সম্ভব হবে না। তারপরে শিলাইদহে কুঠিবাড়ি করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেক। পদ্মানদীতে বোট নিয়ে ঘোরবারও সাহস নেই। কেননা সাঁতার জানি না। তবে আনন্দের কথা যে, পদ্মা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ভাবছি ডাঙার কাছাকাছি কম পানিতে নৌকা নিয়ে ঘুরবো কিনা। কিন্তু শুনছি কোথায় যেন ব্রীজও তৈরি হয়ে গেছে। কাজেই সব মিলিয়ে ভেবেচিন্তে দেখি আরকি! আপাতত ওই দ্বন্দ্বের মীমাংসার আগে চিঠিটা শেষ করা দরকার।
হৃদয়বাদী বুদ্ধদেব ক্রমশ মননশীল কবি হয়ে উঠলেন। যিনি একদিন লিখেছিলেন বন্দীর বন্দনা (১৯৩০), তিনিই তখন লিখলেন যে-আঁধার আলোর অধিক (?)। ঠিক এরকম পরিষ্কার পরিবর্তন বুদ্ধদেবের সমসাময়িক কারো কবিতায় নেই। ফল হলো এই: বুদ্ধদেবের বন্ধু পরিমণ্ডল থেকে বাদ পড়ে গেলেন হৃদয়বাদী পূর্বোক্তেরা। প্রেমেন্দ্র মিত্র দু’বছর পরে কবিতা পত্রিকার সম্পাদনা ছাড়লেন। একই বাড়িতে দোতলা-তেতলায় থেকেও বাল্যবন্ধু অজিত দত্তের সঙ্গে বুদ্ধদেবের বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। বিষ্ণু দের সঙ্গে বুদ্ধদেবের কোথায় যেন একটি ব্যবধান ছিলই বরাবর, সখ্যও ছিল। কলকাতার কয়েকজন কবির মধ্যে দু’টি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল যাদের পরিহাসাঞ্চিত না ছিল ‘বৌদ্ধ’ আর ‘বৈষ্ণব’। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন এ সমস্ত কোলাহলের উর্ধ্বে, এক আশ্চর্য মানুষ ও কবি। তিনি বুদ্ধদেব সম্পাদিত প্রগতি ও কবিতা পত্রিকায় যেমন লিখতেন, তেমনি লিখতেন কবিতা-পত্রিকা ছেড়ে যাওয়া প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত নিরুক্ত পত্রিকায়, তেমনি লিখতেন বিষ্ণু দের সাহিত্যপত্র সাময়িকীতেও। বুদ্ধদেব বসুর এই আশ্চর্য রূপান্তর — হৃদয়শীলতা থেকে মননশীলতার প্রস্থান — একে ভালো-মন্দ যাই বলো একটি বড় ব্যাপার বলে মনে করতেই হয়। উপান্ত জীবনে বুদ্ধদেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন সুবীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তীও খানিকটা।
আধুনিক কবিতা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকা তুলনাহীন। সাধারণ বাঙালি লেখকদের মতো তিনি কেবল আত্মরচনায় তৃপ্ত ছিলেন না। অন্যদের কবিতায়ও অসম্ভব অভিনিবেশ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বিচার তো করেছেনই, তাঁর সমসাময়িক কবিদেরও একত্রিত করেছেন। জীবনানন্দ দাশের সমর্থক ও সম্প্রচারক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য (সঞ্জয় বাবুর কথা জীবনানন্দ প্রসঙ্গে তেমনভাবে আসে না কেন, বুঝি না)।
দ্যাখো, আমরা অনেক সময় একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলি। এটা সবাই জেনে গেছে, জীবনানন্দের আপ্রথমশেষ সমর্থক বুদ্ধদেব বসু। খুব সত্যি। তার সঙ্গে এটা যোগ না-করলে অন্যায় হবে কিন্তু: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেন, এমনকি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধদেবের আক্ষরিক অর্থে অনন্য ভূমিকা ছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই ঋণ শোধ করেছিলেন তাঁর সম্পাদিত একটি কবিতা সংকলনে বুদ্ধদেব বসু (এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে) বর্জন করে। বিষ্ণু দে-র জন্যে সেটা দরকার নেই। তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং আরো কেউ কেউ। একটা বিষয় লক্ষ্য করো: বয়েসে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-অমিয় চক্রবর্তী বুদ্ধদেবের ৮/১০ বছরের বড় ছিলেন, অন্যদিকে সমর-সুভাষ ছিলেন অনেক ছোট। কিন্তু বুদ্ধদেবের লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতা কোথায় তিনি দেখতে পাচ্ছেন। এই কেন্দ্রলক্ষ্যে তিনি অবিচল ছিলেন।
তাই বলে দীপ্তি ত্রিপাঠী তিরিশের যে-পাঁচজন কবিকে চিহ্নিত করেছিলেন, তা আমরা যথার্থ মনে করি না। প্রেমেন্দ্র মিত্র নেই কেন — এই প্রশ্ন শুধু আমার নয়, অনেকের। কবি আবুল হোসেনের অভিমত, সমর সেনকেও তিরিশের কবি হিশেবেই বিবেচনা করা উচিত।
সে যাই হোক, যতজন কবি এখানে উল্লেখিত হলেন — জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত, সুবাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন — সকলের ওপরই বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন। অচিন্ত্যকুমারের কবিতা নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ লিখেছেন বলে মনে পড়ছে না, কিন্তু মন্তব্য তো করেছেনই। এই যে সমকালীন কবিতার প্রতি সর্বব্যপ্ত আগ্রহ এ তো শুধু তাঁর সমকালীন সাহিত্যেই নয়, আগে পরেও বিরল। শুধুমাত্র এই আশ্চর্য গ্রহিষ্ণুতার কারণেই বুদ্ধদেব বসুকে সম্মান জানাতে বাধ্য হই আমরা।
তবে জেনে রেখো, বুদ্ধদেব বসু আমাদের মতো দোষে-গুণে মানুষ ছিলেন। তুমি যে-আদর্শবাদী হিসেবে আমাকে দেখতে চাও তা যে আমি হতে পারছি না এজন্যে আমার একটু দুঃখ আছে। সবাই তো আর রবীন্দ্রনাথের মতো মহামানব নয়। তবে তুমি আবার চটে যেয়ো না রবীন্দ্রনাথের বিরাটত্ব সত্ত্বেও দু’একটি সামান্য ক্রুটি ছিল। সেদিন কোথায় পড়ছিলাম তাঁর গানের ভাণ্ডারী দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের জমিজমা নিয়ে কী যেন গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছিলেন। কাঙাল হরিনাথের ডায়েরিতে একবার পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ জমিদার হিসেবে কেমন ছিলেন তার বিবরণ। তবে সাংবাদিকরা, বোঝো তো অনেক সময় হয়তো একটু রঙ চড়িয়ে… । কাজেই খুব বেশি বিচলিত হোয়ো না।
লেখকঃ আবদুল মান্নান সৈয়দ | ২৮ নভেম্বর ২০০৮
0 মন্তব্য:
Post a Comment