সাম্প্রতিক লেখাগুলো

বুদ্ধদেব বসু ও কালের কৃপাণ

বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যসাধনার বিপুলতা কেবল রবীন্দ্রনাথের খন্ডাংশের সঙ্গে তুলনীয়। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, আত্মজৈবনিক রচনা, ভ্রমণকাহিনী−সব মিলিয়ে তিনি অতুল বৈভবময় সৃষ্টিজগতের অধীশ্বর। আধুনিক সাহিত্যকাল খন্ডায়নের, বিচুর্ণায়নের, নানা একদেশদর্শিতার−আধুনিক সাহিত্যিকজীবন নামক বিশাল-বিপুল যজ্ঞের এক কণাংশের খবরদারি পেলে বর্তে যান। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদের অন্যতম ধারক ও প্রচারক হওয়া সত্ত্বেও নিজের সৃষ্টিশীলতাকে সংকীর্ণতায় নিবিষ্ট করেননি। তিনি দৃশ্যত সেই ধরনের বৈশ্বকোষিক সাহিত্যিকদের মধ্যে শেষতম, যাঁদের দেখা অধুনাপূর্ব যুগে সচরাচর মিলত, যাঁরা সমুদ্রসন্ধানী ছিলেন, যাঁরা একই সঙ্গে সৃজনকলার নানা ভঙ্গিমাকে আরাধ্য করতে পেরেছিলেন। জন্নশতবার্ষিকীর শুভক্ষণে বাংলা সাহিত্যের এই নিবিষ্ট সাধককে অভিবাদন জানাই।

কিন্তু বর্তমান এই নিবন্ধকে যদি শুধু শ্রদ্ধাবাসর করে তুলি, তবে তা কপটতার নামান্তর হবে। আমাদের প্রয়োজন হলো বুদ্ধদেব বসুর উত্তরাধিকারকে বুঝে নেওয়া। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব অনেকটা অবিসংবাদিত হলেও কবিতায় দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর গৌরবময় ভুমিকা সত্ত্বেও তিনি কেন পুরোধাদের মধ্যে গুণক্রমে জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, এমনকি সুধীন্দ্রনাথেরও পশ্চাদ্বর্তী হলেন এবং তাঁর প্রবল শিষ্যদের নানা শ্রমী উদযোগ সত্ত্বেও তরুণ পাঠকদের কাছে কেন তিনি অনাদরণীয় থাকছেন, তার একটি অনুসন্ধান আজ করা যেতেই পারে।

আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় নামের দীপ্তি ত্রিপাঠী-রচিত প্রবাদপ্রতিম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। বুদ্ধদেব বসুর বয়স তখন পঞ্চাশ, তাঁর কাব্যখ্যাতি প্রতিষ্ঠিত; পুনরপি বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা নামের প্রবলপ্রতাপী ও প্রভাবক অনুবাদগ্রন্থ, যেটি অচিরেই উভয় বাংলার তরুণদের ‘আঁখি হতে ঘুম’ হরণ করে নেবে, প্রস্তুয়মান, এবং তাঁর সামনে ‘পথ রুধি’ কোনো ‘রবীন্দ্র ঠাকুর’ বর্তমান নেই। সেই ঘটনার পর আরও পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে; শতাব্দী-ক্রান্তির অন্য আলোয় বুদ্ধদেব বসুকে শুধু নয়, সমগ্র আধুনিক কাব্যমন্ডলকে পুনর্বিচারের প্রয়োজনীয় দুরপ্রেক্ষা আমরা অর্জন করতে পেরেছি বলে আমার ধারণা।

ত্রিপাঠী তাঁর আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় গ্রন্েথ তিরিশ-উত্তর বাংলা কবিতার নাম দিয়েছেন আধুনিক বাংলা কাব্য। এরও পাঁচ বছর আগে বুদ্ধদেব বসু স্বয়ং তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহ-র ভুমিকায় আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায়ন প্রচেষ্টা করেছেন এভাবে: ‘... এই আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকল শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্নয়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন-ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।’ এই সংজ্ঞায়ন যে দ্বিধাগ্রস্ত মাধবীর মতো দোলাচলে দীর্ণ তা বেশ বোঝা যায়। ত্রিপাঠী, বুদ্ধদেবের অনুরাগিণী গবেষক, তাঁর বইতে এই দোলাচলকে ঢাকতে চেয়েছেন, কিন্তু আমরা বুদ্ধদেবের মন সহজে বুঝতে পারি। য়ুরোপীয় আধুনিকবাদ (আধুনিকবাদ শব্দটি অবশ্য বুদ্ধদেব বা ত্রিপাঠী কেউই ব্যবহার করেননি) কবিতার যে সব লক্ষণ নির্দেশ করেছে, সেখানে ‘বিস্নয়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ’ প্রভুত থাকলেও, ‘বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি’ রয়েছে বললে সত্যের অপলাপ হবে। বিশ্ববিধানে এবং এর নিয়ন্তার অস্তিত্বে আস্থাকে ভুমিহীন করার মধ্য দিয়েই অথবা এর ভুমিহীন হওয়ার কারণেই আধুনিক কবিতা তাঁর স্থান করে নিয়েছে নৈরাশ্য আর সংশয়ের পোড়োজমিতে। ‘আকাশভরা সুর্য-তারা বিশ্বভরা প্রাণ’ দেখে ‘বিস্নয়ে’ যাঁর প্রাণ জেগেছিল, তিনি তো ‘প্রাগাধুনিক’ মানুষ রবীন্দ্রনাথ, যাঁর চিত্তবৃত্তিকে অস্বীকার করার মধ্যেই তো ছিল বুদ্ধদেব বসুদের বিদ্রোহ। দীপ্তি ত্রিপাঠী আধুনিক কবিতার যে লক্ষণসংহিতা রচনা করেছেন, সেই দ্বাদশ লক্ষণের মধ্যে ‘বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি’ নেই, বরং আছে ‘ভগবান এবং প্রথাগত নীতিধর্মে অবিশ্বাস’। বুদ্ধদেব বসুকৃত আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলা যায়। মনে হয় তিনি অনেকটা নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে ওই উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। একদা তিনি বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদকে আবাহন করতে গিয়ে কবিতার যে অন্বিষ্ট স্িথর করেছিলেন, তাতে প্রাধান্য ছিল নন্দনবাদিতার, কবির আত্মতার সগর্ব প্রতিষ্ঠা এবং কবিতাকে সমাজপ্রসঙ্গ, নৈতিকতা ও উপযোগিতাবাদ থেকে মুক্ত করে আনন্দের সাহিত্যের আয়োজন। সেখানে ‘বিদ্রোহের, প্রতিবাদের’ কোনো স্থান ছিল না। বুদ্ধদেবের কবিতায় ‘সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের’ চিহ্ন নেই; প্রেমের অসংবৃত উচ্ছ্বাসে আবিল তাঁর প্রথম যৌবনের কবিতা। (স্নর্তব্য, ‘সেরেনাদ’, ‘কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি কবিতায় “কঙ্কা, কঙ্কা, কঙ্কাবতী গো” ধরনের আর্তনাদ। বস্তুত, বুদ্ধদেব যে নজরুলের কবিতা সম্পর্কে কালের পুতুলে মন্তব্য করেছিলেন, “একটি দুটি স্নিগ্ধ কোমল কবিতা ছাড়া প্রায় সবই ভাবালুতায় আবিল”, তা তাঁর নিজের প্রেমের কবিতা সম্পর্কেও অনেকটা প্রযোজ্য।) আর তাই বুদ্ধদেব যখন আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহ সম্পাদনা করছিলেন, তিনি নিজেকে আবিষ্ককার করেন এক বিপুল আয়রনির মধ্যে। তাঁর নিজস্ব আধুনিকতার ধারণার সঙ্গে তাঁর সহযাত্রী-অনুগামীদের মিল নেই এবং তাঁর আত্মতা ও অহংনির্ভর কলাকৈবল্যবাদ কোনো পরিসর পায়নি বাংলা আধুনিক কবিতায়। ওই সংকলনটির সম্পাদনা বুদ্ধদেব বসুর কৃতিত্বের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হলেও এক অর্থে তাঁর নিজের কাব্য-বঃযড়ং-এর মর্মান্তিক পরাজয়ের স্নারকও বটে। নাহলে, কিমাশ্চর্যম, তিনি জসীমউদ্দীনের কবিতাকেও তাঁর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন! তিনি বিস্নয়বিস্কারিত দৃষ্টিতে দেখছিলেন যে, আধুনিক বাংলা কবিতা তাঁর প্রকল্পিত অতি-নান্দনিকতার পথে মোটেই এগোয়নি, বরং বহু বিরুদ্ধপ্রবণতার প্রবল সংঘাতে ও মিথস্ক্রিয়ায় এক আশ্চর্য জটিল রসায়ন হয়ে উঠেছে−যার অংশভাক্ হওয়ার সাধ্য তাঁর আর ততদিনে অবশিষ্ট নেই।

বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতাকে ও সেই সঙ্গে আধুনিক কবিদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছিলেন, এ রকম একটি সযত্নরচিত মিথ প্রবল হয়েছে দীপ্তি ত্রিপাঠীর গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাঙলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রায় ধর্মগ্রন্েথর মতো এ বইটি পাঠ করে। তাঁদের চিন্তায় অনপনেয় মুদ্রিত হয়ে যায় একজন কাব্য-ক্রুসেডারের ছবি, যিনি বাংলা কবিতাকে রবীন্দ্রনাথের ‘কুপ্রভাব’ থেকে মুক্তি দিয়ে আধুনিকতার আঙিনায় মেলে দিয়েছেন; যেন তিনি সেই অপেক্ষিত ভগীরথ, যার অবর্তমানে বাংলা কবিতার স্রোতস্বিনী শুকনো চড়ায় আটকে যেত। ‘প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে প্রগতি পত্রিকায় তিনি আধুনিক কাব্য-যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিলেন এবং বাধাবিঘ্ন সত্ত্বে আজও নৈষ্ঠিক ঋত্বিকের মতো সে-অগ্নি রক্ষা ক’রে চলেছেন। অজস্র কবিতা তিনি রচনা করেছেন, একমাত্র কবিতার জন্যই বিশ বছরের অধিক কাল পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন, কাব্য আলোচনার মাধ্যমে আধুনিক বহু কবিকেই রসিকসমাজে পরিচিত করেছেন এবং সহূদয়হূদয়সংবাদী পাঠকগোষ্ঠি সৃজন করেছেন।’ অনস্বীকার্য যে, বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবি ও কবিতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাঁর রচনাবলির বিশালত্ব ও বৈচিত্র্যও তাঁর বিরাট প্রতিভার স্বাক্ষর। কিন্তু সেইজন্য তাঁকে তিরিশের আধুনিক কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য বলা যায় না। তাঁর নিজের কবিতায় আধুনিকবাদের যে রূপটি তিনি ধারণ করেছেন, সেটি তিরিশের অন্য কবিদের থেকে আলাদা। আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রার্থিতও বটে, কিন্তু যে ব্যাপারটি বিস্নয়কর সেটি হলো, অন্য সব কবির কাব্যাদর্শ, ভাষা ও আঙ্গিক ক্রমবিবর্তমান হলেও এবং শৈল্পিক পরিণতির দিকে অগ্রসরমাণ হলেও বুদ্ধদেবকে মনে হয় এক জায়গায় স্িথর; তাঁর কোনো বিবর্তন নেই। একই প্রগল্ভ উচ্ছ্বাস বন্দীর বন্দনা থেকে মরচে পড়া পেরেকের গান পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর কবিতায় অনুপস্িথত মানসিক দ্বন্দ্ব যা আধুনিক কবিতার একটি মৌল লক্ষণ। জীবন ও ভালোবাসার অদ্বৈতে বিশ্বাসী বুদ্ধদেব বসু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছেন শরীরী প্রেমের কবি; নারী ও বাণীরে তাঁর এক মনে হয়েছে সারা জীবন। কিন্তু জীবন মানেই নারী অথবা নারীর প্রেম−এটি একটি বিষম সমীকরণ, একটি একদেশদর্শিতা। জীবনের আরও বহুতল আছে, আছে মানুষের নানাবিধ আস্তিত্বিক-সামাজিক সংকট। তিরিশের অন্য কবিরা, এমনকি সুধীন্দ্রনাথের মতো নিবিষ্ট প্রেমের কবিও সেইসব প্রস্তাবনাকে কবিতায় ঠাঁই দিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর বেলা অবেলা কালবেলা ও সাতটি তারার তিমির পর্যায়ে মহাপৃথিবী ও মহাকালের অনুধ্যান করেছেন। বুদ্ধদেব বসু প্রেমের কবিই থেকে গেছেন আজীবন−ব্যাপারটি এক অর্থে সংবর্ধনাযোগ্য হলেও সামূহিক বিচারে মনে হয় বুদ্ধদেবের মতো বিরলপ্রতিভ মানুষের জন্য এক বিরাট অপচয় এবং বাংলা কবিতার ক্ষতি। এর একটি কারণ, প্রেমের কবিতাতে তিনি নতুন কোনো মাত্রা যোগ করতে পারেননি, আনতে পারেননি এমন কোনো সুর যা আমরা রবীন্দ্রনাথে শুনিনি, কেবল রিরংসা ও দেহবাদিতার ফ্রয়েডবাহিত অনুষঙ্গটি ছাড়া। অবশ্য সেটিও কল্লোলের কবিকুল তথা মোহিতলালের কবিতায় প্রবলভাবেই মূর্ত হয়েছিল। এলিয়টপ্রেমী বুদ্ধদেব তাঁর গুরুর কাছাকাছিও আসতে পারেননি আধুনিক চৈতন্যের দ্বিধাসংকট চিত্রায়ণে: এলিয়টের প্রুফ্রক যে দ্বিধার করাতে দ্বিখন্ডিত, যে ক্ষণিক উৎসাহ এবং পরক্ষণের অনিবার্য নির্বেদ ও নৈরাশ্যের কাঁটায় ‘কলে-পড়া জন্তুর মতো অসহায়’ মোচড়ায় সে (‘Do I dare/Disturb he universe?/In a minute there is time/For decisions and revisions which a minute will reverse.’) তা বুদ্ধদেবের প্রেমিক-কথকের চিন্তার বাইরে। এমনকি জীবনানন্দের লোকেন বোসও প্রুফ্রকের মতো সময়ের দ্বিরাচারে দীর্ণ: ‘সুজাতাকে ভালবাসতাম আমি−/এখনো কি ভালবাসি?/সেটা অবসরে ভাববার কথা/অবসর তবু নেই.../সে-ও কি আমায়−সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?/আজো ভালোবাসে না কি?/ইলেক্ট্রনেরা নিজ দোষগুণে বলয়িত হ’য়ে রবে;/কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে এর উত্তর হবে?’ (‘লোকেন বোসের জার্নাল’) কিন্তু বুদ্ধদেবের প্রেমিকের মনে এ রকম কোনো ‘overwhelming questions" উত্থিত হয় না; তাঁর নির্দ্বিধ স্বস্তিবোধ আধুনিক মানসতার সুচক মনে হয় না, মনে হয় যেন এক প্রশ্নহীন কিশোরসুলভ মুগ্ধবোধের উচ্চারণ: ‘কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;...তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,/ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।/গাড়ি চ’লে গেলো! −কী ভালো তোমাকে বাসি, কেমন ক’রে বলি।’ (‘চিল্কায় সকাল’) সারা জীবনের কাব্যসাধনাকে তিনি যথার্থই এবং সততার সঙ্গে, বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘যা কিছু লিখেছি আমি−হোক যৌবনের স্তব, অন্ধ জৈব/আনন্দের বন্দনা হোক না−/যা-কিছু লিখেছি, সব, সবই ভালোবাসার কবিতা,/...আজ যদি ভাবি মনে হয়/ নারীরে, বাণীরে এক মনে হয়।/মনে হয় আমার তনুর তন্তুর সীবনে/যে-কবিতার ভালোবাসা ছিলো, তারই শ্বেত শিখার পদ্মেরে/ফুটিয়েছি মনে মনে নারীরে মৃণাল ক’রে;’ (‘মৃত্যুর পরে: জন্েনর আগে’, শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর)

অনেক সমালোচকই এমন প্রেমসর্বস্ব বুদ্ধদেব বসুকে ছেড়ে কথা বলেননি। একজনের মূল্যায়ন এমন: ‘(বুদ্ধদেব বসুর) নারী-চেতনাও মুখ্যতঃ প্রেম-নির্ভর, এবং সে-প্রেমও আবার সর্বাত্মক যৌনতা-নির্ভর।...কিন্তু প্রেম ছাড়া জগতের আর কিছু সম্পর্কে অন্ধতা, কিংবা নারীর পরিচয় একমাত্র প্রেমে, এবং প্রেমের পরিচয় একমাত্র যৌনতায় লুটোপুটি খাওয়ায়, একি আধুনিক মনের জগৎ সম্পর্কে ত"গত দৃষ্টিভঙ্গি? বুদ্ধদেব অত্যন্ত শক্তিশালী কবি, তাঁর কবিতা কবিত্বের দিক দিয়ে অতুলনীয়ভাবে সার্থক; তাঁর চিত্রকল্প, শব্দসম্ভার, অনুপ্রাস, অলঙ্কার, কাব্যরীতি মৌলিক, আত্মপ্রতিষ্ঠ, অভিনব, অপূর্ববস্তুনির্মাণক্ষমপ্রজ্ঞার পরিচায়ক। কিন্তু সব সত্ত্বেও জীবনের আরও বিভিন্ন দিকের বিচিত্র লীলা ও বিবিধ প্রকাশকে উপেক্ষা করা−এ কি আধুনিক সচেতন নিরাসক্ত মানসের পরিচয়বহ?’−(বারীন্দ্র বসু, কবিতা আধুনিকতা ও আধুনিক কবিতা, রত্নাবলী, কলকাতা ১৯৮৭, পৃ: ৭৯-৮০) কৌতুকের ও স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বুদ্ধদেবের কবিতা তখনই শাণিত ও আধুনিক মননস্পর্শী হয়েছে, যখন তিনি প্রেম ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তাঁর স্নরণীয় কবিতা ‘ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা’, ‘ব্যাং’, ‘ইলিশ’, ‘টাইগার হিলে সুর্যোদয়’, ‘মাছ ধরা’, ‘ইকারুস’, ‘বেশ্যার মৃত্যু’ ইত্যাদির বিষয় প্রেম-রিরংসার বাইরে।
বস্তুত, বুদ্ধদেব বসু তাঁর লেখালেখি ও পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে এবং তাঁর প্রবাদপ্রতিম শিষ্যায়নক্ষমতার মাধ্যমে আধুনিক কবিদের যেমন প্রতিষ্ঠ করেছেন, তারচেয়ে অনেক বেশি করতে চেয়েছেন নিজের কাব্যাদর্শের প্রতিষ্ঠা, যে কাব্যাদর্শ মডার্নিজমের একটি বিশেষ, সংকুচিত রূপ। ইংল্যান্ডের প্রি-র‌্যাফায়েলাইট-কবিকুলবাহিত, ওয়াল্টার-পেটারের ঈস্েথটিসিজমের আদর্শে পরিপুষ্ট নান্দনিকবাদ বা কলাকৈবল্যবাদ যার নাম। তাঁর সমস্ত কাব্যকর্মে অমোচনীয় লেগে আছে তাঁর অনড় নান্দনিকতত্ত্ব: তিনি যে আনন্দবাদী সাহিত্যের সাধনা করেছেন, সেখান থেকে সমাজ-সংসার প্রায় নির্বাসিত−শুধু জেগে আছে তাঁর প্রবলপ্রতাপান্বিত একমেবাদ্বিতীয়ম অহং। অস্িনতাভাবনাকে এতটা তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া একমাত্র বুদ্ধদেবের মতো পাশ্চাত্যকলাভাবিত, পড়ুয়া, বিচ্ছিন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাঁর এই ব্যক্তিগত, গবাক্ষহীন ঘরে (‘প্রান্তরে কিছুই নেই, জানালায় পর্দা টেনে দে’) শুধু তাঁর প্রিয়তমা কঙ্কার অধিবাস, যেখানে আসঙ্গপিপাসু-রূপবুভুক্ষু একজন ডেকাডেন্ট তাঁর হাতের তালুতে নিয়ে আঘ্রাণ করেন ইন্দ্রিয়ঘনত্বের সুগন্ধি। ‘আমার আকাঙ্ক্ষা তাই কবিত্বের অদ্বিতীয় ব্রত,/সংঘহীন সংজ্ঞাতীত এককের আদিম জ্যামিতি−/স্তব্ধতার নীলিমায় আত্মজাত পূর্ণতার বাণী।’ (‘উৎসর্গপত্র’, দময়ন্তী) সংঘহীন একাকীত্বের আদিম জ্যামিতি জীবনানন্দেরও অনুধ্যেয় ছিল, কিন্তু জীবনানন্দের কথিত ‘নির্জনতা’র সঙ্গে বুদ্ধদেবের আত্মাপসারণের পার্থক্য রয়েছে। জীবনানন্দ নিজের স্বভাবদোষে আলাদা হয়েছেন; তাঁর আত্মমুখিনতা তাঁর স্বভাবজাত ও স্বতঃস্কুর্ত। বুদ্ধদেব শিষ্যপরিবেষ্টিত, নবসাহিত্যান্দোলনের বৈতালিক বসু, সচেতনভাবে, কৌশল হিসেবে বেছে নিলেন, অন্তত কবিতায়, সমাজরিক্ততার, অনঘ আত্মতার পথ। তাঁর ‘রাত তিনটের সনেট: ১’-এর উদ্ধৃতি দিই। কবির প্রশ্ন, ‘যীশু কি পরোপকারী ছিলেন, তোমরা ভাবো? না কি বুদ্ধ কোনো সমিতির/মাননীয় বাচাল, পরিশ্রমী, অশীতির/মোহগ্রস্ত সভাপতি?’ সুতরাং কবির পরামর্শ, ‘জগতেরে ছেড়ে দাও, যাক সে যেখানে যাবে;/হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম, আর পুলকে বধির।/যে-সব খবর নিয়ে সেবকেরা উৎসাহে অধীর,/আধ ঘণ্টা নারীর আলস্যে তার ঢের বেশি পাবে।’ বিশুদ্ধ আনন্দের পূজারি বুদ্ধদেব ‘পুলকে বধির’ ছিলেন, কালের সমূহ কলাপ কিংবা ক্রন্দন তাঁর কানে পৌঁছায়নি; তিনি থেকে গেছেন নিরুত্তাপ, নিরুত্তেজ রূপসাধক। তবে কালের কৃপাণের সামনে প্রবলপ্রতাপী সম্রাটকেও দাঁড়াতে হয়। বুদ্ধদেব বসুকে কেন যেন মনে হয় আত্মবিশ্বাসহীন ও সশঙ্ক−অন্তত আধুনিক বাংলা কবিতার ভুমিকায় তাঁর দ্বিধাদীর্ণ দোলাচল আমাদের কাছে অস্পষ্ট থাকে না।

লেখকঃ খোন্দকার আশরাফ হোসেন

বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত কবিতা "নবযৌবন"

নবযৌবন

বেদনায় রাঙা মোর দগ্ধ বুক ভরি’
যুগ হতে যুগান্তর ধরি’
কি গান উঠেছে বাজি’, কি সঙ্গীত তুলিয়াছে তান
কোন্ মহামায়া মন্ত্র তুলিয়াছে নিত্য নব গান,
কি সঙ্গীত উঠিয়াছে ধ্বনিয়া
মর্ম্ম মাঝে রণিয়া-রণিয়া,
ওগো মহাকাল,
হে সুন্দর, নিষ্ঠুর, ভয়াল
তোমার ললাট ’পরে লেখা হয়েছিল যদি,
নিরবধি
বয়ে চলা ফল্গুধারা সম
ছিন্ন-তন্ত্রী এই বীণা মম
তোমার বুকের ’পরে জাগায়াছে যদি প্রতিধ্বনি
সে কথায় জেগে যদি উঠেছে অবনী,
তবে ওই ভীষণ মৌনতা
কেন আজ টুটিল তা?
কেন আজ ভেঙে গেল যুগান্তের শৃঙ্খল কঠিন?
প্রসন্ন নবীন
উদিল প্রভাত
অকস্নাৎ,
পোহাইল যেন দীর্ঘ দুঃখ-বিভাবরী,
কেটে গেল মরণ-শর্ব্বরী।

আর ভয় নাই, নাই ভয়,
জীবনে-মরণে আজ, প্রভু মোর, হোক তব জয়!
এনেছে যৌবন তার
বিচিত্র সম্ভার;
বসন্তের ফুলদল হাতে লয়ে এসেচে সে
নব-অতিথির বেশে।
তারে আজ করিনু বরণ,
তাহার পরশ পেয়ে ধন্য হ’ল আমার মরণ,
ধন্য হ’ল দুঃখ-দগ্ধ ক্লান্ত বিভাবরী,
তাই বক্ষ তরঙ্গিত করি,
উঠিয়াছে আনন্দ-হিল্লোল,
চিরন্তন সঙ্গীত কল্লোল
বক্ষে বাজে শঙ্খধ্বনি-সম,
নিরুপম
উচ্ছ্বাসের উন্নত্ত ধারায়,
জীবনের সুত্রগুলি আচম্বিতে কখন হারায়!

চিরদিনকার পাওয়া যৌবন আমার
লহ নমস্কার!
তুমি রুদ্র, তুমি ভয়ঙ্কর,
তাই তুমি অমন সুন্দর।
প্রবালের মতো তব রাঙা ওষ্ঠাধরে
চুম্বন আঁকিয়ে দিতে জন্ন-জন্নান্তরে
সাধ মোর;
অন্ধতার ঘোর
রাত্রির আকাশ সম সুনিবিড় কেশ,
ঊষার উদয় সম চক্ষে তব আনন্দ-উন্েনষ,
বক্ষে তব নবজন্ন আশা
মুখে তব বিশ্বসৃষ্টি ভাষা
সারা দেহে লীলায়িত গভীর বেদন
অনন্ত জীবন আর নিবিড় মরণ
নমি তোমা বার বার, হে আমার অনন্ত যৌবন।

সংগ্রহ ও ভুমিকা: সৈয়দ আবুল মকসুদ
বুদ্ধদেব বসু ঢাকায় ছিলেন ‘মাত্র সাড়ে নয় বছর’ কিন্তু তা ছিল তাঁর ‘জীবনে সবচেয়ে সগর্ভ ও প্রভাবশালী’। ওয়ারি, যুগীনগর ও পুরানা পল্টনে ছিলেন তিনি। ম্যাট্রিক পাস করেন কলেজিয়েট স্কুল থেকে। সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্বে পুরানা পল্টন থেকে প্রগতি বের করেন। ঢাকায় আরও দু-একটি সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তাতে নিয়মিত লিখতেন। তাঁর আমার ছেলেবেলা এবং আমার যৌবনে প্রথম জীবনের সব কথা আসেনি। সেকালের ঢাকার পত্রপত্রিকা এবং তাঁর স্কুল-কলেজের সহপাঠীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত আমার গবেষণাগ্রন্থ বুদ্ধদেব বসু: প্রস্তুতি পর্ব, প্রগতি ও পুরানা পল্টন-এ তাঁর শৈশব ও প্রথম যৌবনের অনেক অজানা তথ্য এবং তাঁর অপ্রকাশিত-অগ্রন্িথত বেশ কিছু লেখা থাকবে। প্রকাশিত হবে ডিসেম্বরে।
‘নবযৌবন’ বেরিয়েছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক উপাসনায় (অগ্রহায়ণ ১৩৩১)।

সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু

১. চলতি সাময়িকপত্রে কবিতা ছাপতে দিতে আজকালকার অনেক কবিই অনিচ্ছুক−এবং এ-অনিচ্ছা অন্যায়ও নয়। কেননা অম্িনবাস্ মাসিকপত্রের পাঁচমিশালী ভিড়ের মধ্যে সত্যিকারের ভালো কবিতারও কেমন একটা বাজে ও তুচ্ছ চেহারা যেন হয়ে যায়। কবিতাকে যথোচিত গৌরবে বিশেষভাবে ছেপে থাকে এমন সাময়িকপত্র বর্তমানে দেশে বেশি নেই। অথচ আধুনিক কবিদের অনেকেই নতুন কবিতা লিখছেন−বাইরের পাঠকমন্ডলী দুরে থাক, সব সময় নিজেদের মধ্যেও সেগুলো দেখাশোনার সুবিধে হয় না। এই কারণে আমরা একটা ত্রৈমাসিক কবিতাপত্র বার করতে বাধ্য হচ্ছি। পত্রিকার নাম হবে কবিতা এবং তাতে থাকবে শুধু−কবিতা।
−বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিচিত্রা, কার্তিক ১৩৪২

২. আধুনিক কবিতা কঠিন বলেই জনপ্রিয় নয়, সহজ হলেই জনপ্রিয় হবে, এ কথা বিশ্বাস করবার তাই কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না: কেননা সুবোধ্য কবিতা যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা আসলে কবিতাই ভালোবাসেন না, কবিতার মধ্যে ইচ্ছাপূরণের উপাদান খোঁজেন মাত্র।
−বুদ্ধদেব বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা, শারদীয় সংখ্যা ১৩৪৬

কল্যাণীয়াসু,
আজ তোমার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদকী সত্তা নিয়ে একটু গল্প করি। তুমি কি বিশ্বাস করবে, তা বছর কুড়ি তো হবেই, আমার আর লিখতে ইচ্ছা হয় না। নিতান্তই সম্পাদক ও প্রকাশকদের ফরমাশে কলম চালাতে হয়। অগ্রজ কবিবন্ধু শহীদ কাদরী বলতেন, ‘আহা, কী ভালোই না হতো, যদি শুধু পড়তে পারতাম−লিখতে না-হতো!’ শহীদ কাদরী, আমার অনুজ কবিবন্ধু আবিদ আজাদের ভাষায় ‘আলস্যের সম্রাট’। আমিও আসলে কিন্তু তা-ই। বাধ্য হয়েই লেখালেখি করতে হয়, নাহলে আমিও ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াতে পারতাম, বা শুয়ে-বসে থাকতে পারতাম। তোমার অতিপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো জমিদারি থাকলে তো কথাই ছিল না।

তবে তোমার পাখির ঝাঁকের মতো চিঠি অলস আমাকে ভালো একটা পথ দেখিয়ে দিয়েছে। একটি নতুন রূপকল্পের সন্ধান দিয়েছ তুমি। নতুন রাস্তায় হাঁটার আনন্দে আলস্য ভুলে গেছি। প্রথম আলোর জাফর আহমদ রাশেদের নাড়ি-ছেঁড়া তাগাদায় সহজ উপায় বের করে ফেলেছি। এই চিঠি।

তবে কথা হচ্ছে: রানি মহলানবিশরা যেমন রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র সব গুছিয়ে রেখেছেন, তেম্িন তুমি আমার এই পত্রাবলি জমিয়ে রাখছ তো? যখন রইব না আমি মর্তকায়ায়, তখন তো শালবন-টন খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, এই পত্রাবলির মধ্যেই স্নরণ করবে আমাকে। আর শোন সব চিঠি তো এখনি ছাপা হচ্ছে না। একবার এন্ড্রুজ্ সাহেব বিদেশ থেকে ফিরলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে তাঁকে লেখা একগোছা চিঠি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তেম্িন সম্পাদক-প্রকাশকদের তাগিদ একটু কমলেই আমি তোমাকে একতাড়া চিঠি দিচ্ছি সাক্ষাতেই। তা নাহলে ধারাবাহিক পত্রাবলি ছাপবে কী করে?

না, দেরি হয়ে যাচ্ছে। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। বুদ্ধদেব বসু কী না লিখেছেন?−কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, স্নৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী, ছোটদের সব রকম রচনা, প্রবন্ধ ইত্যাদি। এসবের বাইরেও পত্রিকা ও গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। এই পত্রিকা ও গ্রন্থ সম্পাদনার বিষয়েই কয়েকটি কথা লিখি। বিস্তারে নয়−সারাৎসারে। একটা স্তবকে। তবে স্তব নয়−যথাসাধ্য নিরপেক্ষতায়।

তুমি তো জানোই, এ বছর বুদ্ধদেব বসু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্নশতবার্ষিকী। বছর শেষ হয়ে এল। এঁদের নিয়ে এমন কিছু হতে দেখবে কি? কিন্তু আমরাই ১৯৯৮-৯৯ সালে নজরুল-জীবনানন্দের জন্নশতবার্ষিকী উদ্যাপন করেছিলাম অনেক বেশি প্রসারে। আরো একজনের জন্নশতবর্ষ এবার−হিমাংশু দত্ত সুরসাগর (১৯০৮-৪৪)। ইনি কে?−অসামান্য একজন সুরকার। কুমিল্লা থেকে তিরিশের দশকে যে-তিনজন গীতিকার, গায়ক ও সুরকার কলকাতায় যাওয়ায় স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম নড়ে বসেছিলেন, তাঁদের একজন। বাকি দুজন অজয় ভট্টাচার্য আর শচীনদেব বর্মণ। সময়টা তো এ রকম নয় যে সম্পাদক হয়ে লেখকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বোধ করবে−নজরুলের সঙ্গে ওঁদের তিনজনেরই সখ্য স্থাপিত হয়েছিল।

সম্পাদক হিসেবে বুদ্ধদেব কিরকম পরিগ্রাহী ছিলেন, তা বুঝবে তুমি দুএকটিমাত্র দৃষ্টান্তেই। বুদ্ধদেব-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকা নজরুল-সংখ্যায় (১৯৪৪) হিমাংশু দত্তের শোক-লিখনও ছিল।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলছিলাম, যিনি বুদ্ধদেবের একেবারে সমবয়সী। বুদ্ধদেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা মীনাক্ষী দত্ত লিখছেন, ‘এর আগে ২০২-এ মদ্যপান হয়নি কখনো। একবার শুধু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছিলাম ঈষৎ বিচলিত অবস্থায়, আমরা বাচ্চারা অবশ্য কিছু বুঝিনি, বড়দের মুখে শুনে পরে বুঝেছি। আর একদিন আমরা বাড়ি ফিরে দেখেছিলাম কুঁচকোনো সিল্কের পাঞ্জাবি পরে তিনি সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। এক সময়ে ২০২-এ প্রায়ই আসতেন তিনি। কিন্তু আমরা বড় হওয়ার পর আর দেখিনি তাঁকে।’ কবিতা-ভবন থেকে প্রকাশিত ছোটগল্প-গ্রন্থমালায় মানিকের একক পুস্তিকাও বেরিয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমসাময়িক কবিদের সম্পর্কে মানিক ছিলেন নীরব−একমাত্র বিষ্ণু দে সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, সেও ‘ড্রয়িংরুম-বিলাসী কবি’ বলে। অন্যপক্ষে বিষ্ণু দে মানিক সম্পর্কে স্িথর স্বস্থ ছিলেন চিরকালই। বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, জীবনানন্দ দাশ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ কবি−যাঁরা গল্প-উপন্যাসও লিখতেন−তাঁরা মানিক প্রসঙ্গে তাঁদের অভিমত জ্ঞাপন করেছেন। বুদ্ধদেব বসু কিছু সমালোচনা করেছিলেন সত্যি কথা, কিন্তু মানিকের মৃত্যুর পর-পরই কবিতাকেন্দ্রিত কবিতা পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। বেশ কিছুকালের পরের এক সাক্ষাৎকারে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। আমি তো পত্রিকা-পাগল মানুষ, ফলে একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর ওই সাক্ষাৎকারটি কীভাবে যেন আমার নজরে পড়ে যায়।

এতক্ষণ ধরে যে-কথা বলতে চাচ্ছি সেটা এই: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কথাশিল্পী হিসেবে, একদম আক্ষরিক অর্থেই, অসাধারণ। কিন্তু বুদ্ধদেব? গ্রহিষ্ণু সমালোচক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুকেও বলব অসাধারণ।

এই কথাও এখনই বলতে পারি: কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব কেবল তাঁর সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ কবিদেরই একত্রিত করেননি, পরবর্তী কাউকে-কাউকেও নয়, তিনি মূলত নিজেকেই পরিপূর্ণ উন্েনাচিত করতে সমর্থ হয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রধান সৃষ্টি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যেমন পরিচয় পত্রিকার, তেম্িন বুদ্ধদেব বসুও কবিতার। একটু বিস্িনত হয়েই লক্ষ করি, তিরিশের অর্থাৎ রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর কবিদের অন্তত বেশ কয়েকজন কবিকে আমরা দেখি তাঁরা সাময়িকপত্র সম্পাদনার মধ্য দিয়ে কেবল নিজেদের বিকশিত করেননি, পার্শ্ববর্তীদেরও অগ্রসরণে একটি বলয় তৈরি করেছেন। তিরিশের প্রধান কথাশিল্পীদের কিন্তু অনুরূপ কোনো ভুমিকায় দেখি না। বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব পত্রিকা ছিল মূলত প্রগতি ও কবিতা; প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছিল শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও মুরলীধর বসুর সঙ্গে কালিকলম, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে কবিতা (প্রথম বছর দুয়েক), সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে নিরুক্ত−প্রেমেন্দ্র মিত্রের স্বভাবে কোথাও একটি পথিকবৃত্তি ছিল (একটি প্রাসঙ্গিক কবিতার পঙ্ক্তি শোনো: ‘যাযাবর হাঁস নীড় বেঁধেছিল বনহংসীর প্রেমে’); সঞ্জয় ভট্টাচার্য বের করেছিলেন পূর্বাশা; এমনকি বিষ্ণু দে-রও পত্রিকা ছিল, সাহিত্যপত্র। মনে রেখো: এঁরা কেউ চাকরিয়া ছিলেন না−প্রত্যেকটি পত্রিকা ছিল ওঁদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রকাশিত অর্থাৎ ‘ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক’ (জীবনানন্দের ভাষায়) সহ্য করেই পত্রিকা বের করতে হয়েছিল ওঁদের। তার ফলেই ওঁদের ওই সাফল্য, এবং আমাকে তোমার প্রদর্শিত পথ ধরে এই পত্র রচনা করতে হচ্ছে।

বুদ্ধদেবের স্বভাব ছিল বিশুদ্ধ শিল্পীর, তাই বলে যাঁরা তাঁকে আত্মবলয়িত বলে বাতিল করতে চান তাঁরা কি যথার্থ বলেন? অন্ততপক্ষে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে বুদ্ধদেব বসু সাতটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন−বাসন্তিকা (১৯২৭-২৮, ঢাকা), প্রগতি (১৯২৭, ঢাকা), কবিতা (১৯৩৫, কলকাতা), চতুরঙ্গ বৈশাখী (১৯৪১), মধুমেলা (ছোটদের বার্ষিকী, ১৯৪২) আর Jadavpur Journal of Comparative literature (১৯৬১)। যে-তালিকাটি তোমাকে বলছি, সেটি সমীর সেনগুপ্তের প্রণয়ন। কিন্তু সমীর সেনগুপ্ত লিখছেন বৈশাখী প্রসঙ্গে, বাংলা সাহিত্যের প্রথম বার্ষিকী এটি। এ কথা তিনি বুদ্ধদেব-জীবনীতেও জানিয়েছেন। তিনি ওয়াকিফহাল নন যে তিরিশের দশকে জাহান-আরা চৌধুরী বর্ষবাণী নামে একটি বার্ষিকী প্রকাশ করেছিলেন, অত্যুৎকৃষ্ট সেই বার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-নজরুল তো লিখতেনই−বুদ্ধদেব বসুও লিখেছেন। তিরিশের দশকেই হবীবুল্লাহ বাহার-নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ানরা প্রাতিকা নামে আরেকটি বার্ষিকী বের করেছিলেন। একটি সংখ্যাই বেরিয়েছিল প্রাতিকার কিন্তু বর্ষবাণী অনেক দিন ধরে অনিয়মিতভাবে বের করে গিয়েছিলেন জাহান-আরা চৌধুরী আর তাঁর ভ্রাতা আলতাফ চৌধুরী। আরো কোনো বার্ষিকী বেরিয়েছিল কি না, তা অনুসন্ধেয়। সাহিত্যে চট্ করে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া ঠিক না।

অনেক বছর আগে একটি প্রাচীন লাইব্রেরিতে বৈশাখী বার্ষিকী দেখেছিলাম−খুব সমৃদ্ধ। যেমন বর্ষবাণী ও প্রাতিকাও নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ। কবিতা পত্রিকার নির্বাচিত রচনার চয়নিকা বেরিয়েছে আগে তিন খন্ডে, এখন বুদ্ধদেব বসুর জন্নশতবর্ষে নতুন করে বেরোচ্ছে ফের। তেমনি প্রগতি ও বৈশাখী বার্ষিকীর অন্তত নির্বাচিত দুটি সংগ্রহ বের হওয়া উচিত।
এই যে পত্রিকা প্রসঙ্গে ‘উৎকৃষ্ট’, ‘অত্যুৎকৃষ্ট’, ‘সমৃদ্ধ’ শব্দগুলি ব্যবহার করছি, কেন করছি। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন খারাপ কবিতা থেকে ভালো কবিতা আলাদা করে নেওয়ার কথা, তেম্িন ঊনমান পত্রিকা থেকে মানসম্পন্ন পত্রিকা চিনে নিতে হবে তোমাদের। অন্তর্বস্তুই আসল। তারপর ছাপা-বাঁধাইয়ের সৌকর্য। দ্বিতীয়টি না-থাকলেও কোনো এসে যায় না।

কবিতায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত।’ লিখে ছিলেন ‘জানালার পর্দা টেনে দে।’ এটা দিয়েই বুদ্ধদেবকে বিচার করা যাবে? পত্রিকার মধ্য দিয়েই তিনি যে-সামাজিক কাজ করেছেন, তা স্বঘোষিত সমাজচেতন কতজন লেখকের দ্বারা সাধিত হয়েছে।
বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত-সম্পাদিত প্রগতি পত্রিকা অথবা বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অন্যদের দ্বারা সম্পাদিত কবিতা পত্রিকা−যাঁর নামই ছাপার হরফে থাকুক, বুদ্ধদেব বসুই ছিলেন কেন্দ্রব্যক্তিত্ব। তাঁর লেখকসত্তা আর সম্পাদকসত্তার মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। প্রতিভা বসুর সম্পাদক-নামাঙ্কিত পত্রিকাগুলির আসলে বুদ্ধদেব বসুই সম্পাদক ছিলেন, এ তো বোঝাই যায়।

বুদ্ধদেব বসুর উন্েনষ ঢাকায়, বিকাশ কলকাতায়। জীবনানন্দের মতো কলকাতা নিয়ে দোলাচল ছিল না তাঁর। বুদ্ধদেব বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেই কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন, ১৯৩১ সালে, তাঁর উদ্দেশ্য পরিষ্ককার: সাহিত্যজগতের কেন্দ্র তখন কলকাতা, পুরোপুরি সাহিত্যে সমর্পিত হলেন। বুদ্ধদেব বসুকেও জীবনসংগ্রাম কম করতে হয়নি, জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত করতে হয়েছে। দ্বিধাপীড়িত জীবনানন্দ কলকাতায় গিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে, দেশবিভাগের আগে, আতঙ্কে, বি. এম. কলেজের চাকরি বহাল রেখে। বুদ্ধদেব তাও কিছুটা জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন, জীবনানন্দের দুর্গতির শেষ ছিল না। এটা বাস্তব তথ্য হিসেবে একেবারে অস্বীকার করা যাবে না যে, পশ্চিম বাংলা-নিবাসী সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে-প্রেমেন্দ্র মিত্র-অমিয় চক্রবর্তী-সমর সেনের আর পূর্ব বাংলা থেকে আগত বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশের অবস্থানে কোথাও-একটু ভিন্নতা ছিল।

কিন্তু ঢাকা বা বরিশাল থেকেই বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ ‘অতি-আধুনিক’ বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। অতি-আধুনিক সাহিত্যের তিনটি বাহনের দুটি বেরিয়ে ছিল কলকাতা থেকে−কল্লোল (১৯২৩) ও কালিকলম (১৯২৬), তৃতীয়টি ঢাকা থেকে প্রগতি (১৯২৭)। প্রগতি প্রথমে ছিল হাতে-লেখা (জানো, আমাদের সময়েও ঢাকায় হাতে-লেখা পত্রিকার চল্ ছিল, এমনকি আমরাও বের করেছি), তা থেকেই বুঝতে পারো: বুদ্ধদেব বসু কেবল আত্মবৃত্তের অধিবাসী ছিলেন না।
প্রগতি পত্রিকায় বুদ্ধদেব জড়ো করেছিলেন যেমন অগ্রজ মোহিতলাল ও নজরুলকে, তেম্িন তাঁর সমসাময়িক নবীন লেখকদের। তখনই তৈরি হয়ে যায় এই ত্রয়ী নায়ক−প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত আর বুদ্ধদেব বসু। তখন থেকেই বুদ্ধদেবের নেতৃত্বেই মূলত আধুনিকতার আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। শনিবারের চিঠিও একই সময়ে বেরোতে থাকে−এবং আধুনিকতার জেহাদ ঘোষিত হতে থাকে। অজিত দত্ত, অমলেন্দু বসু, জীবনানন্দ দাশ−এঁরা সব একত্রিত হয়েছিলেন ঢাকাতেই। পরে তো এঁরা কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হন সকলেই। বুদ্ধদেবের প্রগতি পত্রিকায় কেবল জীবনানন্দের কবিতাই ছাপা হতো না, জীবনানন্দকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে বুদ্ধদেব তখনই লড়াই শুরু করেছিলেন−এবং তাঁর নির্বাচন-যে নির্ভুল ছিল তা আজ প্রগতি প্রকাশের ৮০ বছর পরে বলবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু একা জীবনানন্দকে আবিষ্ককার করেছিলেন বুদ্ধদেব?−কবিতা পত্রিকা যখন ক্রমপরিণত হচ্ছে, বুদ্ধদেবও তখন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিলেন।

তার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। এই চিঠির শীর্ষে যে-দুটি উক্তি উদ্ধৃত করেছি, বুদ্ধদেব বসুর ৬০তম জন্নবার্ষিকীতে জ্যোতির্ময় দত্ত-সম্পাদিত কলকাতা পত্রিকার বুদ্ধদেব বসু-সংখ্যায় উদ্ধৃত হয়েছিল এগুলি। দেখেছ তো, ভালো পত্রিকা মানে শুধু কয়েকটি লেখা সংগ্রহ নয়। ভালো সম্পাদক রচনা-সংগ্রাহক নন।

প্রগতি পত্রিকার প্রথম বর্ষে প্রকাশিত বুদ্ধদেবের একটি প্রবন্ধের (‘বঙ্গ সাহিত্য’) এই উক্তিটিও এই লেখার ওপরে স্থাপন করা যেতো অনায়াসে−প্রায় ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে: ‘এই অতি-আধুনিকদের ভিতর থেকে কেউ কেউ উত্তরকালে যে বাংলার কলালক্ষ্মীকে নব-আভরণে অলংকৃত করবেন, একথা তাঁরা মনে মনে বোঝেন না, এরূপ ইঙ্গিত করে তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তির অবমাননা করব না। সেই জন্যই বোধহয় তাঁদের অন্তরে এত জ্বালা, অপমান করবার আকাঙ্ক্ষা এমন অপরিমেয়।’

প্রগতি পত্রিকায় বুদ্ধদেব ও তাঁর বন্ধুরা ‘অতি-আধুনিক’ সাহিত্যের সপক্ষেই ছিলেন না কেবল, নিজেরাও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। বুদ্ধদেব তখন থেকেই বিচিত্রবিহারী। শনিবারের চিঠি নজরুলের বিপক্ষে অবিশ্রাম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে গেছে। বুদ্ধদেব প্রগতি পত্রিকায় লিখছেন, ‘ব্যঙ্গ ও কটুক্তি করবার জন্যই তাঁরা উন্নুখ, তাই অনিন্দনীয় যে কিছু থাকতে পারে, একথা তাঁরা আমলেই আনতে চান না। নইলে নজরুল ইসলামের গজল-গানগুলির প্যারডি করতে নিশ্চয়ই তাদের হাত কাঁপতো।’

হ্যাঁ, কবিতা পত্রিকার কথা বলছিলাম তোমাকে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল−দুজনই বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান। এঁরা এত বড় যে সাধনা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রধান নন শুধু−একমাত্র; তেমনি ধুমকেতু পত্রিকায় নজরুল ইসলামই সবটুকু জুড়ে আছেন। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে প্রমথ চৌধুরী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা বুদ্ধদেব তেমন নন−এঁদের ঘিরে অন্যরাও বিকশিত-গুঞ্জরিত হয়েছে। কবিতা পত্রিকায় সর্বাধিক লিখেছেন বুদ্ধদেব, কিন্তু তিনি ওই পত্রিকায় জীবনানন্দকে প্রতিষ্ঠা দেননি? একা কেবল জীবনানন্দকেই?−আমরা অনেক সময় ভুলে যাই: অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন, বিষ্ণু দে−পুরো আধুনিক কবিগোষ্ঠীকে তিনি সংহত করে এনেছিলেন একটি বৃত্তে। বুদ্ধদেব ছাড়া আমরা কি পেতাম অজিত দত্তের সেই অসামান্য কবিতাটি−‘মালতী, তোমার মন নদীর স্রোতের মতো চঞ্চল উদ্দাম...’, যা শুনে তুমি রীতিমতো পরিপ্লুত হয়েছিলে। অসম্পুর্ণ ছিল কবিতাটি; কিন্তু বুদ্ধদেব জোর করে অজিত দত্তের কাছ থেকে কবিতাটি না-নিয়ে এলে আমরা কি ওই হিরের টুকরোটি পেতাম! হেমচন্দ্র বাগচী বা নিশিকান্ত (রায় চৌধুরী) কোথায় হারিয়ে যেতেন। এমনকি অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া। চল্লিশের বাম-ডান দুই পক্ষকেই। এমনকি পঞ্চাশের কবিদেরও কারো কারো। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক নিয়ে দীর্ঘ সমালোচনা লিখেছিলেন, সবাই জানি। কিন্তু মণীন্দ্র রায়ের এত কবিতা ছেপেছিলেন−কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখার তালিকা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। অশোক মিত্র দুঃখ করেছেন বা আত্মপ্রশংসাই বলা চলে, করেছেন কলকাতা পত্রিকার ওই বুদ্ধদেব-সংখ্যায় এই বলে যে তাঁরা তিরিশের কবিদের নিয়েই মত্ত থেকেছেন, নিজেদের কথা বলেননি। কেন বলেননি? তিনি তো তাঁর বাম মতাদর্শের বা তাঁর দক্ষিণপন্থী বন্ধুদেরই নিয়ে একটি পত্রিকা বের করতে পারতেন−তাঁর তদানীন্তন রচনায় বুদ্ধদেবকে কটাক্ষ না-হেনে।

তবে, এটা তো মিথ্যে নয়, অন্যদের যত আশ্রয়-প্রশ্রয় দিন, কবিতা পত্রিকার কেন্দ্রে ছিলেন তিরিশের কবিরা। কিন্তু কোন্ পত্রিকা তা নয়? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পঞ্চাশ বছরের বেশিদিন ধরে কৃত্তিবাস বের করে যাচ্ছেন, অতি তরুণ কবিরাও সেখানে পরিগৃহীত হয়েছেন, কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি সংখ্যায়ও দেখলাম রাজত্বে সেই পঞ্চাশের কবিরা। আমাদের বন্ধু ইমরুল চৌধুরী এই তো কিছুকাল আগে কালের যাত্রা নামে একটি পত্রিকা বের করেছিল, তারও তো মুখ্য কুশীলব ছিলাম আমরাই। কিন্তু তার মধ্যেও বুদ্ধদেব অন্যদের কোথায় ছাড়িয়ে গেছেন, দ্যাখো। বুদ্ধদেব তাঁর কবিতা পত্রিকার শতাধিক সংখ্যার মধ্যে বাঙালি কবিদের নিয়ে চারটি বিশেষ সংখ্যা করেছিলেন−রবীন্দ্র-সংখ্যা (জীবনের একেবারে উপান্তে এসে যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ আনন্দিত হয়েছিলেন), নজরুল-সংখ্যা (নজরুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ার পরে-পরেই), জীবনানন্দ-সংখ্যা আর সুধীন্দ্রনাথ-সংখ্যা। আমার বিবেচনায়, কবি ও লেখক নির্বাচনে বুদ্ধদেবের একতিল ভুল হয়নি। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ তিনজন কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ। আর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে আমার ধারণা: তিনি তাঁর প্রাপ্য আদৌ পাননি। দুঃখের বিষয়, ইতিহাসজ্ঞানের অভাবে ইদানীং বাংলাদেশে তিরিশের কবিদের (এক জীবনানন্দ ব্যতিরেকে) বৈদেশিকী বলে খারিজ করবার একটি ঢেউ উঠেছে। এসব পরোক্ষে তাঁদের শক্তিমত্তারই পরিচায়ক বলে বোধহয় দরকার পড়ছে। বৃথা বলে মনে করি।
পুঁথি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সেকালের ভাষায় বললাম। ৭২ বছর বয়সে তোমাদের ভাষা আয়ত্ত করতে পারব না আর।

বুদ্ধদেব কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন। তার মধ্যে অত্যুত্তম আধুনিক বাংলা কবিতা। রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেছিলেন বাংলা কাব্য-পরিচয়, সুর্যকলঙ্ক, সে-বই প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে দীর্ঘ রিভিয়্যু লিখেছিলেন বুদ্ধদেব কবিতা পত্রিকায়। এবং তারই প্রতিবাদে আবু সায়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন কবিতা-ভবন থেকেই আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৪০)। সেটিও বুদ্ধদেবের পছন্দ হলো না। তাই হীরেন্দ্রনাথকে একবারও না-জানিয়ে, হীরেন বাবু তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন, নিজে সম্পাদনা করলেন আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৫৪)। সে-বইয়ের প্রথম সংস্করণে দেখবে মোহিতলালের কবিতা সবশেষে। আর আধুনিক বাংলা কবিতার বুদ্ধদেবের জীবৎকালে প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণ অর্থাৎ পঞ্চম সংস্করণে কথাশিল্পী সন্তোষকুমার ঘোষের রচনাও গৃহীত হয়েছে। স্বপন মজুমদারের ভাষায়, ‘চন্দ্রকলঙ্ক’।

এর উত্তরে তোমার একটি প্রশ্নমালা সমেত চিঠি না পাঠিয়ে, যাতে আমার সুর্যকলঙ্ক বা চন্দ্রকলঙ্ক ঘটে বা রটে, সেরকম চিঠিই পাঠাও বরং।
তোমার কবিশিল্পী/১১ অঘ্রান ১৪১৫

লেখকঃ আবদুল মান্নান সৈয়দ

বাবার কথা - দময়ন্তী বসু সিং

‘বুদ্ধদেব বসুর জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত ছিল ঢাকা শহর, যেমন ছিল আমার মা ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা রানু সোম থেকে কলকাতার বিখ্যাত লেখিকা হয়ে ওঠা প্রতিভা বসুর জীবনও।’ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসুর ছোট মেয়ে দময়ন্তী বসু সিং। সঙ্গে পুরানা পল্টন নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর উচ্ছ্বাসভরা অপ্রকাশিত চিঠি

বাবা বিষয়ে ব্যক্তিগত স্নৃতিচারণা আমি বহুবার বহু জায়গায় করেছি। বিক্ষিপ্ত লেখা ছাড়াও, বুদ্ধদেব বসুর চিঠি: কনিষ্ঠা কন্যা রুমিকে গ্রন্থটি যেহেতু বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের একটি প্রামাণ্য নথি, সেখানে একটি বিস্তৃত ‘স্নৃতি’ অংশ−বস্তুত যাকে ‘মেমোয়ার’ বলা চলে−প্রাক্কথন হিসেবে যুক্ত আছে। আমার বিদেশ গমনের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ‘কবিতা ভবন’-এ (২০২ রাসবিহারী এভিনিউ) জীবনের প্রথম বাইশ বছর কাটাবার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা জরুরি ছিল বইটিকে সম্পুর্ণ করতে। প্রতি চিঠির সঙ্গে দেওয়া আমার টীকা এবং এই দীর্ঘ স্নৃতিচারণা প্রকাশের পর ব্যক্তিগত পারিবারিক গল্প নেহাত পুনরাবৃত্তি হবে। কিন্তু সম্পাদক মশাই ব্যক্তিগত রচনার দাবিতে অনড়।

কী লিখি বলুন তো? বুদ্ধদেব বসু বিষয়ে, তাঁর পরিবার বিষয়ে আপনাদের অজানা তো কিছুই নেই। আপনারা আমার বাবাকে যত ভালোবাসা দিয়েছেন, যত মান্য করেছেন, যত মনোযোগ দিয়ে তাঁর লেখা পড়েছেন, যত আদরে তাঁকে ঢাকার মানুষ বলে আপন করেছেন, সেও তো তুলনারহিত। আপনারাই পুরানা পল্টনে হাঁটেন, যেতে পারেন রমনায়, পড়তে পারেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে, জগন্নাথ হল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আপনাদেরই। সদর্থে, আপনারাই তো তার উত্তরসুরি। আমি-আমরা তো সেখানে হেরেই আছি আপনাদের কাছে। ইচ্ছার সারল্যে ভাবি, ঢাকা গেলেই বুঝি ৪৭ নম্বর পুরানা পল্টনের টিনের ছাদ দেওয়া ছোট্ট বাড়িটি দেখতে পাব, যেখানে আমার বাবা ছোট থেকে বড় হয়েছিলেন, ‘মর্মবাণী’র রাবীন্দ্রিক কিশোর কবি পৌঁছেছিলেন ‘বন্দীর বন্দনা’য়−সারা বাংলা কাঁপিয়ে দেওয়া এক দুঃসাহসী প্রতিভা! নিজেরই মতো সাহিত্যপ্রাণ, প্রতিভাবান এবং মেধাবী কিছু বন্ধু জুটিয়ে নিয়ে বের করেছেন প্রগতি পত্রিকা−প্রথমে তার মুক্তাক্ষরে খচিত, পরে রীতিমতো ছাপাখানায় মুদ্রিত মাসিক। ভাবি, আমিও বুঝি হাঁটব পুরানা পল্টনের মাঠে, চুল উড়িয়ে পাগল করা বাতাসে, উদাত্তকন্ঠে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে যেমন সেই যুবকবৃন্দ করতেন। তা হয় না, তা হওয়ার নয়−জেনেও অবোধ কল্পনা ডানা মেলে ওড়ে।

১.

বুদ্ধদেব বসুর জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত ছিল ঢাকা শহর, যেমন ছিল আমার মা ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা রানু সোম থেকে কলকাতার বিখ্যাত লেখিকা হয়ে ওঠা প্রতিভা বসুর জীবনও। যেকোনো মানুষের জীবনেই পিতা-মাতার প্রভাব সবচেয়ে গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। শৈশব থেকেই আমরা সচেতনে-অচেতনে তাঁদের পদচিহ্ন অনুসরণ করি। তাঁদের মূল্যবোধে আমাদের চরিত্র গঠন হয়, তাঁদের ভালো লাগা-ভালোবাসার মানুষজন ও জায়গাগুলো অজান্তেই আমাদের আপন হয়ে ওঠে। আমার মা-বাবা দুজনেই কট্টর ‘পূর্ববঙ্গীয়’ ছিলেন, কখনোই তাঁরা নিজেদের ঢাকার মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবেননি। আশ্চর্য লাগে ভাবতে সেই ভুমিখন্ড এখনো আমার অদেখা, যেখানে আমার মা-বাবাই শুধু নন, আমার সমস্ত পূর্বপুরুষ জন্েনছিলেন। মা-বাবা দুজনেই যে শহরে বড় হয়েছিলেন, বিখ্যাত হয়েছিলেন, পরস্পরকে প্রথম দেখেছিলেন, সেই ঢাকা শহরের কথা তাঁরাও কখনো ভোলেননি, আমাদেরও ভুলতে দেননি। ঢাকার প্রতি মা-বাবার নস্টালজিয়া আমাদের মধ্যে বাহিত হয়ে এসেছিল অতি স্বাভাবিকভাবে। নিজেদের ‘পূর্ববঙ্গীয়’ পরিচয়ে আজও প্রচন্ড শ্লাঘা অনুভব করি আমরা। জীবনে ঢাকা না দেখে, বিক্রমপুর-মালখানগর-হাসারা না দেখে, সর্বতোভাবে সে দেশের মানুষ বলে নিজেদের এখনো যে আমরা দাবি করি সেও মা-বাবার থেকে আহূত উত্তরাধিকার। কলকাতাই আমাদের একমাত্র শহর হওয়া সত্ত্বেও কদাপি নিজেদের ‘পশ্চিমবঙ্গীয়’ ভাবি না আমরা। দেশ-গাঁ দেখিনি তো কী, বাবা-মার দেশই আমাদের। এখনো আমরা ঢাকা-বিক্রমপুরের লোক, মালখানগরের বসুঠাকুর! আমাদের শিকড় বদ্ধমূল সেই না-দেখা দেশে−পূর্বপুরুষের অস্তিত্বহীন ভিটেয়। পরিস্িথতি ও স্থানকালের পরিবর্তন কিছুই যেন বদলাতে পারে না−লক্ষ-হাজার উদ্বাস্তু এসে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে স্থায়ী বসত গড়ে পূর্ব-পশ্চিমের সব ভেদাভেদ মুছে দেওয়ার পরেও।

এখানে আমাদের পরিবারের একটা নিত্যকার গল্প বলি। ব্যক্তিগত কথাই যখন লিখতে বসেছি বসু পরিবারের এই তথ্যটি লিপিবদ্ধ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বরং প্রকট হবে বুদ্ধদেব বসু-প্রতিভা বসুর সন্তানদের হাড়ে মজ্জায় ও-পার বাংলা এমনভাবে জড়িয়ে আছে কেন!

আমার মা ছিলেন হাসারার সোম, বাবা মালখানগরের বসুঠাকুর। এই বসুঠাকুরদের প্রতি মায়ের প্রবল বীতরাগ ছিল। আসলে তাঁর মামাবাড়িও ছিল মালখানগর−অর্থাৎ আমাদের দিদিমা ছিলেন সেই গ্রামের মেয়ে। ছোট থেকেই মা দেখেছেন তাঁর ভোজনে অত্যুৎসাহী ‘স্বার্থপুর’ দাদুকে (আমিও তাঁকে ছোট বয়সে দেখেছি। খুবই আশ্চর্য, জীবনভর গুরু-ভোজন করেও তিনি ছিলেন রীতিমতো ছিপছিপে চেহারার মানুষ), উগ্রচন্ডী মারকুট্টে মামাকে (ইনি অবশ্য সত্যিই পালোয়ানদের মতো বলিষ্ঠ গুন্ডাজাতীয় ছিলেন, যদিও সেই সময়ে জর্মানি থেকে পাস করা এরোনটিকেল ইঞ্জিনিয়ার−সম্ভবত তৎকালীন ভারতবর্ষের অতি-বিরলদের একজন।), এবং তাদের নিউক্লিয়ার সংসারের একচ্ছত্র সাম্রাজ্ঞী নিজের রাশভারি মা-কে। অনুরাগের পাত্র হিসেবে বুদ্ধদেব বসুকে নিজেই নির্বাচন করলেও বাবার পিতৃপুরুষের গ্রামটি মা-র একেবারেই পছন্দ ছিল না। কারণে-অকারণে বাবাকে তো বটেই, বেচারা আমাদেরও মা-র কাছে সমালোচনা শুনতে হতো মালখানগরের ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে। সম্ভবত শৈশবের কিছু অপ্রিয় স্নৃতি থেকেই তাঁর পরিষ্ককার পক্ষপাত ছিল হাসারা গ্রামের সোমেদের প্রতি। তাঁর বাবা, পিসি, কাকা, দাদু−মা-র মতে এঁরা ছিলেন নম্র, ভদ্র, বিনীত, সুক্ষ্মবোধের মানুষ, মালখানগরের লোকেদের মতো উগ্র নয়, আত্মকেন্দ্রিক নয়, ‘অভ্যাসের দাস’ নয়, দাপুটে নয়, সর্বোপরি লজ্জাহীনভাবে খাদ্য-সম্ভোগী (সোজা বাংলায় পেটুক) নয়! মা বলতেন, মালখানগরের লোকেরাই শুধু পারে এক খাওয়া শেষ হতে না হতেই আরেক খাওয়ার গল্প শুরু করতে। বড়ই তামসিক তারা। মায়ের সব অভিযোগই ভিত্তিহীন এমন হয়তো বলা যায় না, তবে আমরা বুক ঠুকে নিজেদের ‘বাঙাল’ বললেও আমাদের ওপর নঞর্থকভাবে সদাসর্বদা মালখানগরের তকমা লাগানোর ব্যাপারটা আপত্তিজনক মনে হতো, বিশেষত মা যখন একেবারেই সে গ্রামের লোকেদের পছন্দ করেন না। যে গ্রাম, শুধু আমরা নই, বাবাও জীবনে দেখেননি, সেই গ্রাম শুধুমাত্র মা-র দৌলতে স্থায়ীভাবে ‘আমাদের গ্রাম’ হয়ে গেল−বড় হতে হতে সেই গ্রামের সপক্ষে সওয়াল করতেও শিখলাম। সবই অবশ্য মহাশুন্যে লাট্টু ঘোরানোর মতো−বাস্তব ভিত্তি কিছুই নেই, সবই আছে শুধু মনের ভেতরে। কী অদ্ভুতভাবে মা চিরদিন রইলেন তাঁর বাপের বাড়ির অংশ হয়ে−স্বামী-সন্তান এমনকি নিজের মা-কে ‘বসুঠাকুর’ ক্যাম্পের আবাসিক করে দিলেন।

আমার কাছে এই ঘটনাটার বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে এর তাৎপর্য অসীম। সত্যিই কি এক-একটা ‘ক্ল্যানে’র কতগুলো সামান্য চরিত্রলক্ষণ থাকতে পারে? এ তো জিন নয় যে জন্নসুত্রে বাহিত হয়ে আসবে। হ্যাঁ, একটা ‘ক্ল্যান’ যদি বহুদিন সহবাস করে, একধরনের সামান্যমনস্কতা এক পরিবারের লোকের মতো তাদের মধ্যে চলে আসতেই পারে। কিন্তু সে প্রশ্ন যেখানে নেই, সেখানেও কি একই বংশের মানুষদের মধ্যে একই ধরনের চরিত্রলক্ষণ হওয়া সম্ভব?

আমাদের পরিবারের প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন জরুরি, কারণ আমার বাবা জীবনেও মালখানগরের মাটিতে পা রাখেননি; শুধু তাই নয়, তাঁর পিতার অথবা পৈতৃক পরিবারের কোনো প্রভাবই তাঁর জীবনে ছিল না। তিনি নোয়াখালীতে দাদু-দিদার (তাঁর দা এবং মা) কাছে শৈশব কাটিয়েছেন, জন্েনছিলেন কুমিল্লায়। অতি আদরে লালিত শিশু, মা-বাবার অভাব তিনি কখনো জানেননি। কৈশোরে মা এবং দা’র হাত ধরেই চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর জীবনের পুরো ছবিতে মালখানগর কখনোই আসে না। আমাদের প্রসঙ্গ তো না তোলাই ভালো−আমরা তো তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কিছুই দেখিনি। তবুও কি আমাদের স্বভাবে বসুঠাকুর ক্ল্যানের চরিত্রলক্ষণ ছিল? মা নইলে বলবেন কেন? নাকি তাঁর দাদু এবং মামা, হয়তো কিয়দংশে অতীব ব্যক্তিত্বশালিনী মা, এই গ্রামের মানুষদের বিষয়ে কতগুলো বদ্ধমূল ধারণার জন্ন দিয়েছিল মা-র মধ্যে? তবে পরবর্তীকালে কিছু বসুঠাকুরদের দেখে আমরাও কিন্তু তাঁদের মধ্যে স্বভাবগত কিছু কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করেছি। সেগুলো মায়ের সুতীক্ষੲ বিশেষণগুলোর সঙ্গে সর্বাংশে মেলে এমন অবশ্য নয়, তবে খাওয়ার প্রতি এই গোষ্ঠীর কিছু কিছু ব্যক্তির যে সাধারণের চেয়ে অধিক আগ্রহ দেখেছি এ কথা সম্ভবত বলা চলে। আর একটি সাদৃশ্য এঁদের রসিকতার প্রবণতায়। যাকে আমাদের বাড়িতে বলা হতো ‘বল্দা রসিকতা’। মা-র বাকি অপবাদগুলো তাঁর মামাবাড়ির অভিজ্ঞতাজাত বলেই মনে হয়। সত্যি বলতে মায়ের মামার মতো কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি আমি আর কোথাও দেখিনি। এ ছাড়া বলতেই হবে, তাঁর দাদুরও ভোজন ক্ষমতা ছিল অসীম। বাবা তো শেষ পর্যন্ত এঁদের স্নরণ করে ‘সাধুদাদু ও গাবুমামা’ বলে এক ছোটদের গল্পই লিখে ফেললেন!

২.

বাবা নিজে নিতান্ত মিতাহারী ছিলেন, কিন্তু অবশ্যই খাদ্যরসিক ছিলেন। ভোজ, ভোজ্য ও ভোজনকে যে তিনি শিল্পের পর্যায়ে তুলে এনেছিলেন তাঁর লেখায়, তা তো তাঁর সব পাঠকই জানেন। না হলে ‘ভোজনশিল্পী বাঙালি’র (এখানে ‘শিল্পী’ শব্দটি লক্ষণীয়। অনেক ভেবেচিন্তে নামটি দিয়েছিলেন।) মতো প্রবন্ধ, গোলাপ কেন কালোর মতো খাদ্য-নস্টালজিয়ায় ঋদ্ধ উপন্যাস, তিথিডোর-এ স্বাতীর বিয়ের ভোজের অসামান্য বর্ণনা−লিখতেন বা কী করে? বাবা অবশ্য মা-র কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হতেন না, কারণ জীবনে তিনি দুটি ভুমিখন্ডকে আপন করেছিলেন, প্রথম ঢাকা, দ্বিতীয় কলকাতা। এই দুই শহরকে একই আবেগে ভালোবেসেছেন মা-বাবা দুজনেই, কিন্তু বাবার শিকড় ছিল ঢাকায়, আর মা-র ছিল তাঁর দেশে−হাসারায়−যেখানে তাঁদের অভিন্ন হাঁড়ির প্রকান্ড যুক্ত-পরিবার ছিল চার দাদু, অনেক কাকা-পিসি আর রাশি রাশি তুতো ভাইবোনদের নিয়ে। তিনি সম্পন্ন জমিদার পরিবারের মেয়ে হিসেবে নিজেকে জানতেন। তাই গ্রামের গৌরব তাঁর ছিল। বাবার সেসবের বালাই ছিল না, অতএব ঢাকাই তাঁর সব পেয়েছির দেশ। তবে মায়ের নিজের ‘দেশ’ ছিল বলে তিনি বাবাকে এবং পিতৃসুত্রে আমাদেরও একটি ‘দেশ’ দিয়েছিলেন−অন্তত কোথাও যে আমাদের খুঁটি পোঁতা আছে সে বোধকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে শুনে শুনে শুধু ঢাকা নয়, আমরা হাসারা-মালখানগরকেও নিজেদের বলে জানতে শিখেছি। যেহেতু আমরা নিজেদের কখনোই পশ্চিমবঙ্গীয় ভাবতে পারি না, বলতে পারি না আমরা ‘কলকাতার লোক’, তাই আমাদেরও যে শিকড়ভুমি আছে−সদর্থে না থাকলেও অস্তিত্বে আছে−সেই জ্ঞানেও আমাদের সুখ। বাবার কাছে ঢাকা ছিল জন্নদাত্রী মা, কলকাতা পালক পিতা।

৩.

একটি চিঠি। লিখেছিলেন আকৈশোর প্রাণের বন্ধু পরিমল রায়কে, যিনি থাকতেন পুরানা পল্টনে বাবার আস্তানা থেকে অল্প দুরে ‘পরম ভবনে’। পরিমল রায় এ-পারে এসে স্থায়ী হন দিল্লিতে। বাবা এই চিঠিটি লিখছেন ১২ অক্টোবর ১৯৫১ সালে বাংলা-বিহারের বর্ডারে একটি (এখন সম্ভবত ঝাড়খন্ড) ছোট শহর চাঁইবাসা থেকে। বন্ধু ন্যু ইয়র্কে কর্মরত ইউনাইটেড নেশন্সের অর্থনীতিবিদ। চিঠিটি অংশত এখানে উদ্ধৃত করছি কেন তা স্বতই প্রতিভাত হবে।

পরিমল,
চিকিৎসাশাস্ত্রের উত্তরকান্ডে বায়ু পরিবর্তন নামক যে অধ্যায়টি আছে তার তাড়নায় আমরা কয়েকটি প্রাণী ছিটকে পড়েছি কলকাতার বাইরে। তুমি এখন মেটকাফ হাউসের বাদশারূপে অধিষ্ঠিত থাকলে হয়তো দিল্লিতেও দৌড়তুম, কিন্তু তুমি যেহেতু যমুনাতীরবর্তী সেই কক্ষবহুল ভবনটিকে অনাথ করে ইতিমধ্যে ন্যু ইয়র্কে চলে গেলে, তাই সিংভুম জেলায় চাঁইবাসা নামক জনপদটি এবার আবিষ্ককার করা গেলো। আছি শহরতলিতে; যাঁরা আশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের গার্হস্থ্য কলরব ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এখানে;−যদি না গাছের পাতার শোঁ শোঁ এবং গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার ছপছপ−এগুলি ‘শব্দে’র মধ্যে ধরো− খুব নির্জন নিস্তব্ধ জায়গাটা, চারদিকের দিগন্ত পাহাড়শ্রেণীতে ঘেরা, একটু উঁচু-নিচু উন্নুক্ত প্রান্তর যতদুর চোখ যায় চ’লে গেছে। ক-দিন ধ’রে মেঘবৃষ্টি চলছে; রাত্রে মেঘ-চোঁয়ানো অতি ক্ষীণ ভুতুড়ে জ্যোৎস্মায় ঈষৎ-উদ্ভাসিত দিগন্ত-ছোঁওয়া প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে পুরানা পল্টনের কথাই মনে পড়ছিল বারবার। কী মজা দ্যাখো, তোমার ন্যু ইয়র্কে গিয়ে পুরানা পল্টন মনে পড়ে, আমার মনে পড়ে চাঁইবাসা লক্ষেੲৗ দিল্লি এমনি নানা জায়গায় যেখানেই অনেক মস্ত মস্ত ফাঁকা মাঠ আছে;−মনে হয় পুরানা পল্টনের মতো, কিন্তু ঠিক সে রকম না; পল্টনের মাঠের মতো সুন্দর পৃথিবীর অন্য কোনো মাঠ আমাদের চোখে লাগবে না। তার কারণ এ নয় যে ঐ প্রান্তর রূপগৌরবে শ্রেষ্ঠ−ভাবতে গেলে জায়গাটা অতি সাধারণ ভিন্ন কিছুই নয়−কিন্তু ওখানে আমরা যুবক ছিলাম, উন্নীলিয়মান সদ্য যুবক, আমাদের কাছে সেটাই ওর মহিমা, যে মহিমার তুলনা নেই। আমার লেখার মধ্যে পুরানা পল্টনের কথা এতবার এসে গেছে যে ভেবে অবাক লাগে−খারাপও লাগে এক-এক সময়, মনে হয় বৈচিত্র্যের অভাব ঘটছে; তবু এখনো এক-এক সময় আবার নতুন ক’রে লিখতে ইচ্ছে করে; মনে হয় অনেক কথাই বলা হয়নি, সেখানকার দিন, রাত্রি, বিকেল, সন্ধ্যা, স্তব্ধ মধ্য রাত্রির আশ্চর্য নীল সিনেমার মতো জ্যোছনা, তার ঠিক সুরটি, স্পর্শটি, আবার নতুন ক’রে ধরতে ইচ্ছে করে। ...তুমি আবার চিঠি লিখো কলকাতার ঠিকানাতেই এবং পারো তো কিছু মার্কিন ছড়া পাঠিয়ো। সস্ত্রীক আমাদের বিজয়ার প্রীতি নিও।
বুদ্ধদেব

এ চিঠি ন্যু ইয়র্কে পৌঁছবার দু’দিন আগে মাত্র ৪২ বছর বয়সে পরিমল কাকার আকস্িনক মৃত্যু হয়। বন্ধুকে শোকবিহ্বল করে তিনি চলে গিয়েছিলেন কোন অসীম পরিসরে কে জানে! পুরানা পল্টনের নস্টালজিয়া থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন কি? বাবাকে দেখে মনে হয়েছে এ নস্টালজিয়া থেকে এঁদের প্রজন্েনর মুক্তি হওয়া সম্ভব নয়। কেন, তা এই চিঠিই বলে দেয়। পুরানা পল্টনের মাঠ জুড়ে আছে তাঁদের প্রথম যৌবন, তাঁদের তীব্র বন্ধুতা, তাঁদের অবাধ স্বাধীনতা, তাঁদের অন্তহীন স্বপ্ন। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে বাবার জন্য তা ছিল পুরানা পল্টনের মাঠ।

এই পরিবারে বড় হয়ে আমি নিজেকে ও-পারের মেয়ে ছাড়া কী-ই বা ভাবতে পারি! হয়তো ভালোই যে আমি কোনো দিন চক্ষু দিয়ে ঢাকা দেখিনি। থাক না আমার মা-বাবার দেশ আমার মানসে এক অপার্থিব স্বপ্ন হয়ে।

ঢাকা।
থাক না আমার মনের মধ্যে আঁকা
যাদু-মাঠের কল্প
পরিকথার গল্প
বাবার বোনা সৃষ্টি
মায়ের চোখের দৃষ্টি
আমার মনে স্বপ্ন হয়ে থাকা
ঢাকা।

(অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিতব্য একটি সংকলনের জন্য লেখা। লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।)

উৎসঃ প্রথম আলো

শার্ল বোদলেয়ারের নির্বাসিত কবিতার বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক অনুবাদের নির্বাচিত অংশ

‘‘নিলো সে আমার কাম তারপর পালঙ্কবিতানে
এলিয়ে ঈষত্ হেসে তাকালো সে অলসনয়না
সমুদ্রের মতো নম্র অতলান্ত আমার কামনা
ছুঁলো তার তুঙ্গ চূড়া জোয়ারের প্রবল উত্থানে

বুঝে নিলো পোযমানা বাঘিনীর চতুব কৌশলে
তার শ্লথ স্বপ্নিল দেহের লাস্যে আমার আহ্লাদ
যে ভঙ্গি যখনই বাছে, তা-ই পায় প্রখর আস্বাদ
সরলে পিচ্ছিলে মেশা লাবণ্যের সহজ হিল্লোলে’’

- অলংকার

‘‘ঘাঘরায় গন্ধ ঝরে, ঝিমঝিম ঝরায় মনে
সেখানে কবর খোঁড়ে আমার এ খিন্ন মাথা
মৃত সব প্রণয় আমার, বাসি এক মালায় গাঁথা,
নিশ্বাস পূর্ণ করে কী মধুর আস্বাদনে’’

- লিথি

‘‘হতে চাই তোর ফুল্ল তনুর হন্তা
ক্ষমাশীল স্তনযুগলে আঘাত ক’রে -
এবং ঊরুর বিস্মিত অন্তরে
দীর্ঘ, কঠিন, ক্ষমাহীন এক ক্ষন্তা

তারপর - এ কী মধুর অপস্মার! -
ঐ অভিনব, উজ্জ্বলতর ঠোঁটে
সনির্বন্ধ প্রতিহিংসায় ছোটে
আমার তীব্র গরল - বোন আমার !’’

- অতিশয় লাস্যময়ীকে

‘‘নিঃশব্দ শূন্যতাময় পেগানের প্রাচীন গুহায়
ধুপতির ধূমালোকে কেউ কেউ তীব্র জ্বরে কাঁপে
বিক্ষেপের আলোড়নে যাচে এক সক্ষম সহায় -
হে বাকুস, ঘুম দাও আমাদের আদিম সন্তাপে !

আরো আছে - আকণ্ঠ গুন্ঠন টেনে সন্ন্যাসিনী সাজে
গম্ভীর কাননে যারা, জনহীন স্তম্ভিত নিশায়
লুকিয়ে ভীষণ কশা আলম্বিত বসলের ভাঁজে
ফেনিল প্রমোদপুঞ্জে যন্ত্রণার ক্রন্দন মেশায় ।’’

- পাতকিনী

‘‘শুষে নিলো আমার পঞ্জর থেকে সব রক্তরস
মায়াবিনী, আর আমি, লালসার আহ্লাদে অবশ,
চুম্বনে উদ্যত হয়ে চেয়ে দেখি, জীর্ন পুঁটুলিতে
ভরা আছে পুঁজ, ক্লেদ, অনুলিপ্ত ঘৃণ্য আঁটুলিতে।
ঠান্ডা ভয় হঠাত্ নয়নে দেয় যবনিকা ফেলে,
তারপর বাস্তবের দিবালোকে দৃষ্টি ফিরে পেলে
দেখি, যে আমার পাশে পরাক্রান্ত রঙিন পুতুল,
শোণিতের ঋণে ছিলো সঞ্জীবনে আপাতপ্রতুল -
সে কোথায় শুধু এক কঙ্কালের বিধ্বস্ত বিকার,
আবহকুক্কুট যেন, নড়ে উঠে ছড়ায় চিত্কার’’

- পিশাচীর রূপান্তর

বুদ্ধদেব বসু'র "মুক্তিযুদ্ধের কবিতা"

আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পোড়ো না, কথা ব'লেও নষ্ট কোরো না এই রাত্রি-
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।

কেন না কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হ'য়ে গেছে,
কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই;
তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল-
অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন।

কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন,
তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু?
বোলো না 'সুন্দর', বোলো না 'ভালোবাসা', উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না
নিজেদের-
শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে।

আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই,
যার উপর দিয়ে বাতাস ব'য়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে,
যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ-
নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন।

আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।
দেখবে কেমন ছোটো হ'তেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধ'রে যায়,
যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর, যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো
অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ-

সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত,
যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়,
রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ-
যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব

সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে,
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়-
সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের।

আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ,
প্রাণ কত বিপন্ন।
কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান,
যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর
মৃত্তিকায়-
চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত।

তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি,
আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া?
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের-
যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।

নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক,
যারা ভোলোনি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে,
রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য
এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা :

আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ-
সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে
নিশান।
মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে
শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার।

বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথা “আমার যৌবন” এর নির্বাচিত অংশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিভিন্নজনের নানা ধরনের লেখা পড়েছি। বাবার কাছে সাতত্রিশ বছর আগের ঢাবির বর্ণনা শুনেছি। তবে, সব কিছু ছাপিয়ে গেছে কবি বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথা “আমার যৌবন”। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হন। তার বই হতে কিছু অংশ সকলের জন্য তুলে ধরলাম।

কার্জন কল্পিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে তৈরি হয়েছিল রমনা – অনেকের মুখে তখনও নাম ছিল নিউটাউন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমলে এখানেই অধিষ্ঠিত ছিল ঢাকা কলেজ, বঙ্গভঙ্গ ভেস্তে যাবার প্রায় দেড় দশক পরে, সেই পুরানো বিদ্যাপিঠকে কেন্দ্র করে স্থাপিত হলো নতুন এক বিশ্ববিদ্যালয় – নবনির্মিত অব্যবহৃত প্রাণপ্রাপ্ত হলো। রেল লাইন থেকে শহরের ভিত্তি প্রান্ত পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি; উত্তর অংশটি সরকারী কেষ্টবিষ্টুদের বাসভূমি, মধ্যিখানে আছে বিলেতি ব্যসন ঘোড়াদৌড়ের মাঠ, গলফ্‌ খেলার মাঠ, আছে ঢাকার নাগরিকদের পক্ষে অপ্রবেশ্য ঢাকা ক্লাব,.. আর আছে কানন বেষ্টিত উন্নতচূড়া একটি কালী মন্দির। কিন্তু, দক্ষিণ অংশটি পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারভুক্ত; যেখানে ছাত্র ও অধ্যাপক ছাড়া ভিড় দেখা যায় শুধু শীতে ও বর্ষায় শনিবারগুলোর অপরাহ্নে যখন জুয়াড়ি এবং বেশ্যায় বোঝাই খড়খড়ি তোলা ঘোড়ার গাড়ি ছোটে অনবরত রেসকোর্সের দিকে শান্ত রমনাকে মর্দিত করে, কলেজ ফেরত আমাদের চোখে মুখে কর্কশ ধুলো ছিটিয়ে দিয়ে। আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ অন্তরঙ্গ ক্যাম্পাসটিতে ঐ একটি বই অপলাপ ছিল না।

ভেতরে বাইরে জামকালো এক ব্যাপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরো-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস – ফাঁকে ফাঁকে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ। ইংলন্ডদেশীয় পল্লী কুটিরের মতো ঢালু ছাদের এক একটি দোতালা বাড়ি-নয়নহরণ, বাগান সম্পন্ন: সেখানে কর্মস্থলের অতি সন্নিকটে বাস করেন আমাদের প্রধান অধ্যাপকেরা; অন্যদের জন্যেও নীলখেতে ব্যবস্থা অতি সুন্দর। স্থাপত্যের কোন একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়া দিল্লির জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি। বিজ্ঞান ভবনগুলি আরক্তিম ও তুর্কি শৈলীতে অলংকৃত। অন্যান্য বিভাগ স্থান পেয়েছে একটি বহুপক্ষযুক্ত দীর্ঘকার সাদা দোতালার একতালায়- সরকারী সেক্রেটারিয়েট হবার জন্য তৈরি হয়েছিল বাড়িটি। সর্বত্র প্রচুর স্থান, ঘেঁষাঘেষি ঠেলাঠেলির কোন কথাই উঠে না।

ভিতরকার ব্যবস্থাপনাও উচ্চাঙ্গের। ঘরে ঘরে বিরাজ করছেন, নানা নামাংকিত কর্তৃবৃন্দঃ ডীন, প্রভোস্ট, প্রক্টর এবং বিভাগীয় শীর্ষস্থানীয়েরা-ক্বচিৎ-দৃষ্ট, ক্বচিৎ-শ্রুত ও ক্বচিৎ-কথিত উপাচার্য মহোদয়ের কথা ছেড়েই দিচ্ছি। এঁদের কোনজনের সঙ্গে বিদ্যার্থী ঠিক কোন সূত্রে যুক্ত হয়ে আছে, তা সমঝে নিতে নতুন ভর্তির বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। আক্ষরিক অর্থে আবাসিক নয়-কিন্তু গড়ন কিছুটা সেই ছাঁচের; যে সব ছাত্র স্বগৃহবাসী শহরের নানা অঞ্চল থেকে সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসে, তাদের সংলগ্ন থাকতে হয় কোন না কোন হল অথবা হোস্টেলে – তাদের প্রাচীরাতিরিক্ত ক্রিয়াকর্মের সেটাই হল ঘটনাস্থল। সেখানে আছে গ্রন্থাগার, রঙ্গালয় ও ক্রিয়াঙ্গন; অনুষ্ঠিত হয় বিতর্ক-সভা, সঙ্গীত-প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ভোজ ও আরো অনেক সময়োচিত অধিবেশন; সেখানকার নাট্যাভিনয় দেখতে নগরবাসী সোৎসাহে সমবেত হন। ক্লাস ফুরানো মাত্র কলেজে সঙ্গে সম্পর্ক চুকলো, এমন এখানে হতেই পারে না-কেননা প্রায়ই আমাদের ফিরে আসতে হয় কোনা-না-কোন সান্ধ্য অনুষ্ঠানে – মনোজ্ঞ না হোক অন্ততপক্ষে কৌতুহলজনক। আর যেহেতু ছাত্ররাই এই অনুষ্ঠান গুলোর আয়োজন ও প্রযোজক এবং মাস্টারমশাইরাও কেউ-না-কেউ উপস্থিত থাকেন ও অংশও নেন মাঝে মাঝে, তাই ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে একটি পারিবারিক সান্নিধ্যবোধ অনুভূত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের খাসমহলেও মনোরঞ্জনী উপাচার ছিল। মনে পড়ে ছাত্রে কমনরুমচিত্রে প্রথম ঢুকে আমি চমকে গিয়েছিলাম, আমাদেরকে বিশ্রামের জন্য এই ব্যবস্থা তা প্রায় বিশ্বাস করতে পারিনি। ঘরটি দুই কামরায় বিভক্ত, আয়তনে বিশাল ও আসবাবপত্রে ঋদ্ধিশালী। প্রধান কক্ষটিতে সারি সারি আরাম কেদারা সাজানো, টেবিলে টেবিলে ছড়িয়ে আছে সব সম্ভ্রান্ত বাংলা মাসিক ও পাঞ্চ থেকে রিভিউ অব রিভিউজ পর্যন্ত রং-বেরঙের লন্ডলি চালান- দুই ক্লাসের মধ্যবর্তী পঞ্চান্ন মিনিটি চমৎকার কেটে যায় সেগুলো উলটে পালটে। আর যারা ভিন্ন ধরনের বিনোদনপিয়াসী তাদের জন্য আছে দেয়াল ঘেঁষে তাসের টেবিল দাবার ছক, ছোট কামরায় পিংপঙের সরঞ্জাম। ছেলেরা আড্ডা, গল্প, সিগারেট চালায় যথেচ্ছ, কর্তৃপক্ষ এতটাই সুবিবেচক যে, যথেষ্ট সংখ্যক ছাইদান যুগিয়েছেন; যৌবনকন্ঠের কলরোল ঠেকাবার জন্য ভিতরদিকের দরজাগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এই কমনরুমে বসেই আমি প্রথম পড়েছিলাম, ‘প্রবাসী’র পৃষ্ঠায় ধারাবাহিক ‘শেষের কবিতা’ আর ‘বিচিত্রা’য় ‘তিনপুরুষ’ , দুকিস্তি পরে রবীন্দ্রনাথ যার নাম বদলে যোগাযোগ রাখলেন, ‘যুনিভার্সিটি জার্নাল’-এর কার্যালয়ে, ইংলন্ডজাত উঁচকপালে ও আধা-উঁচকপালে পত্রিকাও চেখেছিলাম।

তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দ্বিতীয় রঁদেভু আদিত্যের দোকানটি বড়ো দরিদ্র। কম্পাউন্ডের এক প্রান্তে টিনের চালওয়ালা দর্মার ঘর, ভিতরে মলিনবর্ণ টেবিলের পাশে লম্বা ন্যাড়া টুল পাতা: এখানেই আমরা ক্ষুৎপিপাসা নিরবারণ করে থাকি, যেহেতু সারা তল্লাটে দ্বিতীয় কোন চা ঘর নেই। আদিত্যের ভোজ্যতালিকা অতি সীমিত, কোনো কোনদিন তার স্বহস্তে প্রস্তুত মিস্টান্ন ছাড়া আর কিছুই সে দিতে পারে না চায়ের সাথে-কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না আমাদের, গদ্য-পদ্য সমস্ত খাদ্যই আমাদের কাছে উপাদেয় ও সুপাচ্য, সেগুলোর রাসায়নিক গুনাগুন নিয়ে চিন্তিত হবার মতো দুর্দিন তখনও বহুদূর। আমরা জুটি সেখানে বন্ধুর দল- টুনু (কবি ও অধ্যাপক অজিত কুমার দত্ত), অমল (পরে অধ্যাপক অমলেন্দু বসু), পরিমল (ধনবিজ্ঞানী), ছোট পরিমল রায় (ঢাকা ও দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক), আরো অনেকে-ছুটির ঘন্টায় বা কখনো ক্লাস পালিয়ে, বসি গোল হয়ে। ঘন সবুজ ঘাসের উপর ঘনিষ্ট, ফরমায়েশের পর ফরমাশ ছাড়ি আদিত্যকে, অনেকখানি মাঠ পেরিয়ে আমাদের কলহাস্য ধ্বনিত হয় এক ক্লাস ঘরে, যেখানে চারু বন্দোপাধ্যায় কবিকংকন পড়াচ্ছেন। দাম দেবার জন্য পকেট হাৎড়াবার প্রয়োজন নেই, ‘লিখে রেখ’ বলাই যথেষ্ট।

আমাদের পাঠাভ্যাস সংক্রান্ত-ক্রিয়াকর্ম চলে সুনিয়মিত ও স্বচ্ছন্দ: মৌলিক শৃংখলার যেটুকু দাবি তা আমাদের পক্ষে কখনই পীড়াদায়ক হয়ে উঠে না। আমাদের সাবালকত্ব এখানে স্বীকৃত, আমাদের স্বাধীনতা বহুদূর পর্যন্ত অবাধ। পরীক্ষার খাতায় নিজস্ব মতের ঘোষণা, মাস্টারমশায়ের অনুমোদিত ভাষ্যের প্রতিবাদ; লাইব্রেরীর অন্দরমহলে ঢুকে যথেচ্ছ বিহার – এসব আমাদের অধিকারভুক্ত; আমাদের সহজ অনুভূতিগুলো অসম্মানিত হয় না, আমাদের ব্যক্তিত্ব বিকশিত হবার সুযোগ পায়। সাহিত্য বিভাগে দ্বৈতীয়িক গ্রন্থের ব্যবহার অল্প; কোনো প্রথিতযশা সমালোচক কি বলেছেন, তার চেয়ে অনেক জরুরি হল লেখকের সাথে অন্তরতা। আবহাওয়াটি সত্যি উদার, কিন্তু এর একটি ব্যতিক্রম উল্লেখযোগ্য।

একমুঠো ছাত্রীও আছেন আমাদের সঙ্গে- আছেন এবং অনেক বিষয়ে নেই। যেমন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, পৃথকৃত ও সুরক্ষিত এক অতি সুকুশর উপবংশ, তারা অবকাশের প্রতিটি মিনিট যাপন করেন তাদের পর্দায়িত বিশ্রাম-কক্ষে, অধ্যাপকদের নেতৃত্ব ছাড়া সেখান থেকে নিস্ক্রান্ত হন না। প্রতিটি ঘন্টা শুরুতে এবং শেষে করিডোরগুলো বিভিন্নমুখি মিছিলে ভরে যায়, মহিলাগুলোকে পশ্চাৎবর্তীকরে চলেছেন এক একজন অধ্যাপক, পুনশ্চ নির্বিঘ্নে পৌছে দিচ্ছেন তাদের কমনরুমের দোরগোড়া পর্যন্ত। ক্লাসে তাদের জন্য বসার ব্যবস্থা আলাদা, আমাদের বেঞ্চিগুলো থেকে দূরে বসানো চেয়ারে, সেখানে তারা চক্ষু : নত রাখেন পুঁথির উপর, কোন প্রশ্ন করেন না অধ্যাপককে, পাঠ্য বিষয়ে হাসির কথা থাকলেও তাদের গাম্ভীর্যে টোল পড়ে না। এমন নয় যে, করিডোর বা ক্লাসের মধ্যে কোন দৃষ্ট ভ্রমর কখনো ছুটে আসে না আমাদের দিকে কিন্তু দর্শন পেরিয়ে শ্রবনে তারা কখনোই প্রায় ধরা দেন না, শুধু মূক শ্রোতার ভূমিকা নেন নাট্যাভিনয় বক্তৃতা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরে আমি প্রকাশ্যে ছাত্রী কন্ঠ শুনেছিলাম একবার মাত্র- শুধু মেয়েদেরই জন্য আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায়: ছাত্রছাত্রীর মধ্যবর্তী এই স্বচ্ছ দেয়ালটিকে একেবারে নীরান্ধ্র ভাবলে কিন্তু ভুল হবে: বেয়ারার হাতে চিরকূট পাঠিয়ে ‘লেডিজ’ কমনরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে, কোন বাসন্তীদের বা অমিতা চন্দর সঙ্গে দুচার মিনিট কিছু অর্থহীন কথা বলা এবং শোনা যায় না তা নয়- কোন কোন বদ্ধপরিকর ছাত্র তা করেও থাকে- কিন্তু দেখে মনে হয় উভয়পক্ষই অপ্রতিভ স্বাচ্ছন্দরহিত, আলাপ ঠিক জমছে না অথবা একে আলাপ বলাটাই ভুল। ব্যাপারটা খুব কৌতুক শোনাবে আজকের দিনে, কারো কারো পক্ষে অকল্পনীয়। কিন্তু প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগেকার বাঙালি সমাজে, হাজার খানেক নবযুবার মধ্যে পনেরো কুড়িটি বিদ্যার্থিনী তরুণী নিয়ে এই ব্যবস্থাই স্বাভাবিক ও সংগত ছিল তা মানতে হবে।।..

সেই সময়কার কথা ভাবলে আমি নিজেকে দেখতে পাই রমনার একটা রাস্তায়, যা চলে গেছে পুরনো পল্টনের মোড় থেকে সোজা পশ্চিমের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বার পর্যন্ত এক মাইল। ... পাঁচ মিনিট পরে সুন্দরের মধ্যে সব থেকে সুন্দর সেই তথাকথিত চামারিয়া হাউস (বর্তমান সিরডাপ হাউস); সেখান থেক বেরিয়ে এলেন পাঁচটি অথবা সাতটি সহপাঠিনী, আমি চলার গতি শ্লথ করে দিলাম যাতে অন্তত: পেছন থেকে তাদের নিরীক্ষণ করা যায়। সৈনিক অথবা খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীদের মতো শ্রেণীবদ্ধ হয়ে হাঁটছেন তারা সমতলে পা ফেলে ফেলে, মাথা আঁচলে ঢাকা, চওড়া পাড়ের সাদা সাদা শাড়ি পরনে, যৌবন সুলভ চঞ্চলতার কোনো লক্ষণ নেই, আর পা ফেলে এমন ঢিম লয়ে, যে একটু পরেই তাদের অতিক্রম না করে আমার উপায় থাকে না। পথে পথে আরো অনেক চেনামুখ, কখনো দেখি বিজ্ঞান বিখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ বসু চলেছেন মন্থরচনে – হাতে গোল্ড ফ্লেকের টিন, জামা বোতামহারা, চুল উশকোখুশকো, ছাঁটা চুল। চোখে সোনার চশমা, গিলে করা চুড়িদার পাঞ্জাবিতে সুপ্রশাধিত যেই যান বিরল পথেও অতি সতর্ক সাইকেল চালিয়ে আস্তে আমাকে ছাড়িয়ে যান ডক্টর সে সংস্কৃত বাংলার অধ্যাপক সুলীল কুমার। বা হয়তো দেখা যায় –জগন্নাথ হলের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে ঢুকলেন ইতিহাস বিশারদ রমেশচন্দ্র মজুমদার, যুবকদের চাইতেও দ্রুত এবং বলিষ্ঠ তার পদক্ষেপ অথবা, আমি যখন কলেজের গাড়ি বারান্দায় ঠিক তখুনি সাইকেল থেকে নামেন আমাদের ইংরেজী বিভাগের সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যার তুল্য লাজুক অধ্যাপক আর নেই- আমাকে দেখে ইষৎ লাল হন তিনি, মৃদু কেশে নরম আওয়াজে বলেন, “এই যে বুদ্ধ ভালো আছ?’ আমি করিডোর দিয়ে যেতে যেতে শুনি ঘন্টার শব্দ।

লেখকঃ বিবর্তনবাদী

বুদ্ধদেব বসু'র অনুবাদ কবিতা

মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার
অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু


কাকে তুমি ভালোবাসো মানুষ?
তোমার বাবা, মা, বোন, ভাইকে?
-পরিবার বলতে কিছু ছিলনা আমার।
-তোমার বন্ধুদের?
-তুমি এমন একটি শব্দ ব্যবহার করছো, যার অর্থ আমি আজ পর্যন্ত বুঝিনি
-তোমার দেশ?
-কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান আমি জানিই না!
-কোন নারীকে?
-আমি আনন্দের সাথেই তাকে ভালোবাসতাম, যদি হতো সে কোন দেবী, অমর...
-অর্থ? সম্পদ ভালোবাসোনা তুমি?
-ঘৃণা করি, যেমন তুমি কর ঈশ্বরকে!
-তবে কী ভালোবাসো তুমি অদ্ভুত মানুষ?
-ভালোবাসি ওই আকাশে...সুদূরে...দূর নীলিমায় ভেসে যাওয়া আশ্চর্য মেঘদল!...

বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষ : অন্য মূল্যায়ন

তাঁর জন্মশতবর্ষে এসে উত্তরসূরিদের এ কথা স্বীকার করা প্রয়োজন, বুদ্ধদেব বসুর ঋণ শোধ করার যোগ্যতা এককভাবে আমরা এখনো খুব বেশি অর্জন করতে পারিনি। কারণ তিনি বাংলা কবিতার এমন এক আশ্চর্য চিরনতুন শিক্ষক, যার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আমাদের খুব সহজে ফুরোবে না। বাংলাদেশে কবির সংখ্যা চিরকালই বেশি, উত্তম কবির সংখ্যাও সুপ্রচুর। অথচ কবিতার খাঁটি শিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। এর কারণ হয়তো এই, কবিরা তাদের পাঠ, দেখা, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যা কিছু অর্জন করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কেবল তাদের কবিতার ভেতর দিয়েই প্রকাশ করেন। ক্বদাচিৎ গদ্যচর্চা করলেও, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের মধ্যে কবিতার মতো সমান বা তীব্র সাধনা খুব কম ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর। কিংবা কবির গদ্য হয়তো অনেক ক্ষেত্রে তার চিন্তার সেই অবশেষ, যা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে পারেন না বলে গদ্যের আশ্রয় নেন। অথবা সেগুলো হয়তো উপলরক্ষের লেখা।

কিন্তু কবি বুদ্ধদেব বসুর শিল্পচর্চার অপরাপর মাধ্যমও যে সমান তীব্র এর প্রকৃষ্ট প্রামাণ্য তার প্রবন্ধ ও অনুবাদসকল। তিনি তার কবিতার সমান তাড়না নিয়েই অসামান্য সব গদ্য লিখেছেন এবং অসম্ভব সুন্দর বহু অনুবাদ করেছেন।

আমরা যখন তার অনুবাদে বোদলেয়ারের বিস্ময়কর সব পঙ্ক্তিগুচ্ছ পাঠ করি :
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...ঐ উঁচুতে... ঐ উঁচুতে...
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
অথবা,
আক্ষেপ, আক্ষেপ শুধু! সময়ের খাদ্য এ-জীবন,
যে-গুপ্ত শত্রুর দাঁতে আমাদের জীবনের ক্ষয়
বাড়ায় বিক্রম তার আমাদেরই রক্তের তর্পণ।

কিংবা হ্যেল্ডার্লিন থেকে :
তবে এসো, মধুর, কোমল সুপ্তি! হৃদয়ের অভিলাষ
অত্যধিক, অসম্ভব। কিন্তু শেষে, হে যৌবন, অস্থির, স্বপ্নিল,
তুমিও হারাবে তাপ, আর ধীরে বার্ধক্য আমাকে
দেবে শান্তি, সান্ত্বনা, বিরাম।

কিংবা রিলকে থেকে :
পাতা ঝরে, পাতা ঝরে, শূন্য থেকে ঝ`রে প`ড়ে যায়,
যেন দূর আকাশে বিশীর্ণ হ`লো অনেক বাগান;
এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত।
এবং পৃথিবী ঝরে প্রতি রাত্রে গতিপথচ্যুত,
নত্রশৃঙ্খল ছিঁড়ে-- নিঃসঙ্গতায়।

আমরাও ঝ`রে যাই। এই হাত-- তাও পড়ে ঝ`রে।
দ্যাখো অন্য সকলেরে : সকলেই এর অংশীদার।

কিংবা পাস্তারনাক থেকে :
তোমার কঠিন পণ ভালোবাসি আমি,
আমার ভূমিকার অভিনয়ে আছি সম্মত।
কিন্তু এবার এক ভিন্ন পালা শুরু হ`লো;
এই একবারের মতো দাও আমাকে নিষ্কৃতি।

কিন্তু অঙ্কগুলির পারম্পর্য অনড়
আর পথের শেষ আমাকে মুক্তি দেবে না;
নিঃসঙ্গ আমি; সব ডুবে গেলো ধর্মান্ধের শঠতায়।
মাঠ পেরোনোর মতো সহজ নয় বেঁচে থাকা।

তখন এইসব অসামান্য ও সপ্রাণ পঙ্ক্তিগুচ্ছ আমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন, প্লাবিত, মুগ্ধ করে যে, মনে হয় কোথায় অনুবাদ, কোথায় বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, রিলকে বা পাস্তারনাক-- এ যেন কবি বুদ্ধদেব বসুরই এক অন্তর্গত প্রগাঢ় স্বর। এর কারণ সম্ভবত একটাই, বুদ্ধদেব অনুবাদেও তার কবির চৈতন্যকেই বহাল রেখেছেন। নিজের কবিতার জন্য তিনি যে অপত্য স্নেহ লালন করেন, অন্য ভাষার, সুদূরের, অন্য সময়ের কবির কবিতার প্রতিও একই মমত্ব পোষণ করেন। আর এটা বড় পষ্টভাবেই অনুভব করা যায় তার করা অনুবাদ বইগুলির ভূমিকাসকল পাঠ করলে (যেমন : কালিদাস, বোদলেয়ার, হোল্ডারলিন, রিলকে)। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরি, বুদ্ধদেব বসু যে সময়ের কবির কবিতাই অনুবাদ করুন না, কবিতার বিষয়মূলকে অক্ষুন্ন বা অ-ব্যাহত রেখেও, তিনি বাংলায় এর রূপ দিয়েছেন তার সমকালীন ও নিজস্ব কাব্যভাষায়। ফলে, তার কবিতা ও অনুবাদ হয়ে উঠেছে অনেকটা সমার্থবোধক। এ প্রসঙ্গে তার নিজেরই এক ধরনের স্বীকারোক্তি রয়েছে কোনো এক গদ্যে, যেখানে তিনি বলেছেন, যখন দিনের পর দিন কবিতা লিখতে পারতেন না, তখন, তার স্বভাবজাত সৃষ্টিতাড়না, অনুসন্ধান ও পাঠস্বভাবহেতু, ভিনভাষী কবিদের কবিতার রস আস্বাদন করতেন এবং কখনো-সখনো অনুবাদ করতেন। এগুলোও অনেকটা তার নিজস্ব কাব্যবন্ধ্যাকালেরই সৃষ্টি, কিন্তু এগুলোর উৎস আর অজ্ঞাত বা অদৃশ্য বহুমাত্রিক উপাদান নয়, বরং তার পূর্বজ ভিনভাষী কবিদেরই সৃষ্টি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোনো কোনো একচক্ষু অধ্যাপক-সমালোচক মনে করেন, তার নিজের কবিতাও নাকি অনেকাংশে এসব কবিতারই অবশেষমাত্র। তবে এমত ধারণার নেপথ্যে বুদ্ধদেব নিজেও খানিকটা দায়ী। কারণ, তিনি অনুবাদেও এত বেশি নিখুঁত, সযত্ন, সহৃদয় আর বাঙালি যে, যদি ওইসব কবির নিজদেশী উপাদান, চরিত্র ও পুরাণকে তিনি যথাযথ ব্যবহার না করতেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকেও তার নিজের কবিতা বলেই চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা এখনো পর্যন্ত পশ্চিমকেই উন্নত ও শ্রেষ্ঠতর বলে ভাবি, তাই আমাদের অজান্তেই বুদ্ধদেবকে ছোট করে দেখি। তার সৃষ্টিশীলতা, নিষ্ঠা ও সততার কথা আমাদের মনেই থাকে না। অথচ তিনি তার প্রতিটি অনুবাদ-বইয়ে যেভাবে ভূমিকা ও টীকাভাষ্য দিয়েছেন, সেগুলোর জন্য যে ধরনের মেধা ও শ্রম তাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, তার দিকে নজর দিলেই টের পাওয়া যায় তাকে কী অসাধ্যসাধন করতে হয়েছে। তবে প্রভাবের কথা বলতে হলে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি ঋণ কেবল পশ্চিম থেকেই নেননি, তার মতো সর্বভূক শিল্পসাধক আধুনিক-প্রাচীন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সবখান থেকেই তার অন্তর্জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণেই ইউরোপ থেকে তার গ্রহণের পরিমাণটা বেশি। কিন্তু এই কূপমণ্ডুক জাতির ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা তা হলো তিনি নিজেকেই কেবল ঋদ্ধ করেননি, নিজ ভাষায় নিজ জাতির জন্য সেগুলো আমৃত্যু দু হাতে অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। এবং নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার প্রগাঢ় শিক্ষক। কারণ বুদ্ধদেব বসুর ব্যাপারটা এমন নয় যে, তিনি মাস্টারির দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে উদ্ধারের মিশন গ্রহণ করেছিলেন (যদিও তিনি পেশাগতভাবেও জীবনের অনেকটা সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক! বরং বলা উচিত, ভারতবর্ষে একাডেমিকভাবে তুলনামূলক সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়েছে তারই নেতৃত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে)।

আসলে তার এই শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারটিও ছিল অনেকটা প্রাকৃতিক ঘটনার মতো। `প্রাকৃতিক' এই অর্থে যে, প্রকৃতির যে সূত্রে তিনি কবি, সে অর্থেই তিনি কবিতারও শিক্ষক। এ দায়িত্ব তাকে কেউ অর্পণ করেনি, কিংবা তিনি যে শিক্ষকতা করছেন এই মাস্টারি-মনোভাব নিয়েও তিনি কবিতার শিক্ষকতা করতে নামেননি। বরং বিশ্বকবিতার বিস্তীর্ণ সমুদ্রে তার যে স্বভাবজাত স্নান ও ডুব দেওয়া এবং সেখান থেকে তার যে নিবিড় আহরণ, এবং পরবর্তীকালে উত্তরপুরুষের জন্য সহৃদয়হৃদয়সংবাদী করে উপস্থাপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, এটিই তাকে পরিণত করেছে এক গভীরতর শিক্ষকে।

কবিতা যে কেবল ভাব দিয়ে রচিত হয় না, একটি কবিতার কবিতা হয়ে উঠার জন্য যে অনেকগুলো অভাব মেটাতে হয়, এ কথাটি এই একুশ শতকে এসেও অনেকে বুঝতে চান না। আবার কবিতার জন্য যে শিক্ষা ও দীক্ষা প্রয়োজন এটিও কবি ও পাঠক উভয়েই বিস্মৃত হয়ে পড়েন। শিল্পকলার অপরাপর মাধ্যম যেমন : সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও লেখালেখির, কবিতার স্কুল আমাদের দেশে ছিল না কোনোকালে। কিন্তু স্কুল থাক বা না থাক, না থাক প্রশিক্ষণশালা, যে জাতির রবীন্দ্রনাথ আছে, যার মধ্যে অতীত ও আগামীর অপূর্ব মিলন ঘটেছে, যিনি শুধু শিল্প-সাহিত্য-চিন্তার এক গভীর সমুদ্র ছিলেন না, বরং স্বজাতির জন্য খুব সহজ করে সেসব উপস্থাপনও করে গেছেন, সেখানে কোনো স্কুলের দরকারও তো হয় না। সেগুলো একটু কষ্ট করে আগ্রহ নিয়ে পাঠ করলেই তো হয়ে যায়। এর বাইরে প্রাচীন-নতুন অপরাপর জ্ঞান-চিন্তা-তত্ত্ব তো আছেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো সে অজ্ঞানতার আঁধার গেল না। আশ্চর্য ব্যাপারটা হলো, এই আক্ষেপ প্রায় সত্তর বছর আগে (১৯৩৮ সালে) বুদ্ধদেব বসু তার এক লেখায় যেভাবে করেছেন, আজও প্রায় একই ভাষায় আমাদেরও আক্ষেপটা করতে হয় (দ্রষ্টব্য : `লেখার ইস্কুল', কালের পুতুল)। এবং এর ফল এই যে, বুদ্ধদেব বসুর মতো দ্রষ্টা-শিক্ষকের কাছে আমাদের ঋণ ক্রমাগত বেড়ে চলে।

এর মানে এই নয় যে, আমরা বুদ্ধদেব বসুদের পর আর এগোইনি। বরং বাংলা কবিতা আরো বহু দূর বিস্তৃত হয়েছে। তার অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই যে অগ্রগতি (যদিও তা প্রশ্নাতীত নয়, এবং আমাদের কবিতা, বিশেষত তিরিশ ও এর পরবর্তী মূলধারার কবিতায় পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ নিয়ে যে বিতর্ক, তার কথা মনে রেখেও), তার নেপথ্যে যদি কাউকে যথাযথ শিক্ষকের অভিধা দিতে হয়, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই দিতে হবে বুদ্ধদেব বসুকে। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতাকে যেমন নতুন সম্ভাবনায়, চিন্তায়, ভাষায় আরো উত্তুঙ্গতায় পৌঁছে দিয়ে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার নতুন দরোজা খুলে দিয়েছেন, আর সেই দরোজায় তার সমসাময়িক ও উত্তরকালের কবি-সমালোচক-পাঠকের অবাধ প্রবেশ করার জন্য যিনি সবচে বেশি জীবনপাত করেছেন তিনি বুদ্ধদেব বসু। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দেড় দশক আগে উচ্চারিত বাংলা কবিতার নীরব সাধক পঞ্চাশের দশকের কবি আজীজুল হকের একটি মৌখিক উক্তি : তিরিশের কবিতা যে আজকের বাংলা কবিতার মূলধারা, তা যতটা সে সময়ের কবিদের কবিতার জন্য, ততটাই এর সপক্ষে বুদ্ধদেব বসুর মতো কবি-গদ্যকারদের নিরন্তর গদ্যরচনার জন্য।

আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করি, যখন এমনকি রবীন্দ্রনাথও ঠিক তাঁর প্রতিভা বুঝে উঠতে পারেননি, বরং তার কবিতা সম্পর্কে দায়সারাভাবে বললেন `তোমার কবিতায় তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে', `শব্দ নিয়ে এত জবরদস্তি করো কেন বুঝিনে', তখন তরুণ বুদ্ধদেব বসুই প্রাথমিক জীবনানন্দকে গভীরভাবে আবিষ্কার করলেন এবং জীবনানন্দের বহু সাহিত্যশত্রুর বিরুদ্ধে প্রায় একাকী কলম চালিয়ে তাকে সাহিত্য-অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। `প্রাথমিক জীবনানন্দ', কারণ, বুদ্ধদেব বসু, পরিণত জীবনানন্দ দাশকে কখনো কখনো ভুল পাঠ করেছেন, বিশেষত, বুদ্ধদেব ধূসর পাণ্ডুলিপি-বনলতা সেন পরবর্তী জীবনানন্দর ওপর অজ্ঞাত কারণে খুব নাখোশ হয়েছিলেন এবং জীবনানন্দকে রীতিমতো আক্রমণ করে লিখেছেন। তবে পরবর্তী সময়ে আবার তিনি তার আস্থা ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষণিক এই ভ্রান্তির কারণে তার অবদান খাটো হয়ে যায় না, কেননা, জীবনানন্দ দাশের জন্য তার যে একক শ্রম, তা এখনো অনেক জীবনানন্দ-গবেষকের চেয়েও বেশি এবং জীবনানন্দর কবিতার ক্ষেত্রে তার অনেক বিশ্লেষণ চিরন্তনতার মাত্রা পেয়ে গেছে।

একইভাবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার বহুমাত্রিক ও আবিষ্কারধর্মী নানা মূল্যায়ন অনেক ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব। তিনি যে বললেন,`বাংলা সাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত হ`য়ে আছেন তিনি, বাংলা ভাষার রক্তে-মাংসে মিশে আছেন; তাঁর কাছে ঋণী হবার জন্য এমনকি তাঁকে অধ্যয়নেরও আর প্রয়োজন নেই তেমন, সেই ঋণ স্বতঃসিদ্ধ ব`লেই ধরা যেতে পারে-- শুধু আজকের দিনের নয়, যুগে-যুগে বাংলা ভাষার যে-কোনো লেখকেরই পক্ষে। আর যেখানে প্রত্যভাবে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘ`টে যাবে, সেখানেও, সুখের বিষয়, সম্মোহনের আশঙ্কা আর নেই; রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশই বিস্তৃত হ`য়ে, বিচিত্র হ`য়ে প্রকাশ পাবে বাংলা সাহিত্যে।'
[`রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক`, সাহিত্যচর্চা]

এই উক্তির মধ্যে ভক্তির চেয়ে পাঠ বেশি, আবেগের চেয়ে দূরদৃষ্টি বেশি। বুদ্ধদেব ১৯৫২ সালে এই উক্তি করার পর আরো পঞ্চান্ন বছর কেটে গেছে। এখন রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই আমাদের রক্তের গভীরের জিনিস হয়ে উঠেছেন, তাকে ছাড়া আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো কিছুই আর চলে না, যেমন করে বাতাস অদৃশ্য হলেও তাকে আমাদের অস্তিত্বের জন্যই প্রতিটি মুহূর্তে প্রয়োজন হয়।

বুদ্ধদেবের ভাষার এমন এক মাধুর্য আছে, আছে এমন এক পেলবতা আর অক্ষরবৃত্তিক গতি, এর মোহ কাটানো বড় মুশকিল। যদিও অনেক সমালোচক তার ভাষার কমনীয়তা ও রমণীয়তা নিয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, কিন্তু তারা বোধহয় এই কথাটি ভুলে যান যে, এই ভাষার গুণেই তিনি আমাদের প্রতি শিক্ষকতাটি প্রকৃষ্টভাবে করতে পেরেছেন। কারণ, ভাষার এই গুণটি তার না থাকলে আমাদের বঞ্চনার পরিমাণ বৃদ্ধি ছাড়া কমত না এবং তার ভাষার স্বাদই আমাদের এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যা ছাড়া ওই বিষয়গুলোতে হয়তো আমাদের আগ্রহই জন্মাতো না।

খটখটে পাণ্ডিত্য জিনিসটি হয়তো বুদ্ধদেব বসুর ধাতে কখনোই সইত না। তাই বিষয় যত কঠিনই হোক, বোঝা ও অনুভব করার গুণে সেগুলো তার ভাষায় বাংলাদেশের জল-হাওয়া-মাটির মতোই সহজ ও সজল হয়ে প্রকাশিত হতো, এই মাটির সন্তান হওয়ার কারণে স্বভাবেও আসলে তিনি ছিলেন এমনটিই। এর একটি চমৎকার উদাহরণ, ১৯৫২ সালে রচিত তার একটি বিশ্লেষণী ও আত্মউপলব্ধিমূলক গদ্য `হেমন্ত' (সঙ্গ-নিঃসঙ্গতা : রবীন্দ্রনাথ)। লেখাটিতে আমরা দেখি, বাংলার একটি অবহেলিত ঋতু বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন বাংলার ঋতুগুলোরই সজীব ইতিহাস। পাশাপাশি ঋতুটিকে ঘিরে তিনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যর প্রকৃতি-সমাজ-সাহিত্যের এক তুলনামূলক বয়ানও হাজির করেন তার অনবদ্য ভাষায় এবং ক্রমাগত নিজেকে খন্ডন করতে করতে তিনি পৌঁছতে চান এই সত্যে যে, হেমন্ত নিয়ে তিনি এতকাল যে মনোভাব পোষণ করেছেন, তা ছিল একপেশে ও খন্ডিত। এই মধ্যবয়সে এসে তিনি এর সত্যিকার রূপ সন্দর্শন করলেন।

অন্যদিকে আধুনিক বাংলা কবিতার ইউরোকেন্দ্রিকতা ও তিরিশি বিতর্কের অন্যতম অভিযুক্ত নায়ক বুদ্ধদেব বসু। তাকে আক্রমণ করা সহজ, কেননা এই তাত্ত্বিক লড়াইয়ের জন্য নানাভাবে তিনিই সবচেয়ে বেশি উপাদান আমাদের যোগান দিয়ে গেছেন। তাদের পাঁচ নায়কের মধ্যে, তিনিই সাহিত্যের সব শাখায় ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়। ফলে তাকে সবচেয়ে সহজে পাওয়া যায়। বুদ্ধদেব বসুরা যে আধুনিকতা বাংলা কবিতায় আমদানি করেছেন, তা ইউরোপীয় আধুনিকতা। তার যে সময় ও নগরচেতনা তারও কেন্দ্রে আছে ইউরোকেন্দ্রিকতা। রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে যাওয়ার নামে তারা দ্বারস্থ হয়েছেন পশ্চিমের কাছে এবং সেখানকার বহু উপাদান অবলীলায় বাংলা কবিতায় আমদানি করেছেন এই ভূগোলের মাটি-মানুষ-শেকড় ও ঐতিহ্যের কথা ভুলে গিয়ে। ফলে তিরিশ ও এর পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতা, হয়ে উঠেছে, বাংলা ভাষায় রচিত ইউরোপীয় কবিতা। অভিযোগ সঠিক হলেও এ উক্তি যেরকম মোটা দাগে উচ্চারিত হয়, ব্যাপারটা এত স্থূলভাবে দেখার মধ্যে একটু সমস্যা আছে। এই দায় কতটা তাদের, পরবর্তীকালের কবিরাই বা এ থেকে উত্তরণের জন্য কী করেছেন এবং এই সময়ের কবিতাই বা কতটা মোহমুক্ত ও শেকড়সংলগ্ন হতে পেরেছে, এসবেরও প্রকৃত বিচার করা কর্তব্য।
কিন্তু এই তত্ত্বজটিল প্রসঙ্গটি অন্যত্র আলোচনার জন্য তুলে রেখে এবং ইতিহাসের এই দায় থেকে তাদের মুক্তি না দিয়েও বুদ্ধদেব বসুর সপক্ষে কিছু সাধু কথা উচ্চারণ করা বাস্তবসঙ্গত ও ন্যায়োচিত।

বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে উপনিবেশিত হওয়া অনেকটা নিয়তির মতো, যে নিয়তির আগ্রাসনে একদিন ইউরোপই ইউরোপের আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল (যেমন : জার্মানদের মধ্য থেকে ইংরেজদের পত্তন, ফরাসি জাতির ইংল্যান্ড আগ্রাসন, ইংল্যান্ডের আয়ারল্যান্ড দখল। গ্রিক-রোমান সভ্যতার চিন্তা ও ভাষাগত আধিপত্য। আপাতত তোলা থাক অন্য মহাদেশে তাদের দখল-হত্যা-লুণ্ঠন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক আধিপত্যর কথা।)। কিন্তু এতো সব নেতি উপাদানের পরও ইউরোপ থেকে তিনি যে শৈল্পিক-মানবিক গুণগুলো আত্মীকৃত করেছেন, সেগুলোর মূল্য না দিলেও বড় ধরনের অবিচার করা হবে। বুদ্ধদেব বসু অন্ধ ইউরোপপন্থি ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের মাত্রাজ্ঞান তার কী মাত্রার ছিল, তার জন্য তার মেঘদূত বইটির ভূমিকাই উৎকৃষ্ট সাী। পরন্তু শিল্পের স্বয়ম্ভুতা, যুক্তির বোধ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের যে তুলাদ�

লেখকঃ সৈকত হাবিব

বুদ্ধদেব বসু'র কবিতা - "চিল্কায় সকাল"

কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি?
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;

কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
স্টেশনে গাড়ি এসে দাড়িয়েঁছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চ’লে গেল!- কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি?

আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায়না।
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত!
-তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো
যা এতদিন পাইনি?

রূপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে; সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর
সূর্যের চুম্বনে।-এখানে জ্ব’লে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধণু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে?

কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কতদূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে।- কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে আর আমার
কী ভালো লেগেছিল।

তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ মুখ। দ্যাখো, দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ-আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।

জিজ্ঞাসায় বুদ্ধদেব বসু

জ্বল জ্বল করতে থাকে নিটোল অক্ষর৷ হস্তাক্ষর৷ তার ওপর গিয়ে পড়ে কবির চোখ৷ চিকচিক করে ওঠে সেই চোখ৷ আর ওই চোখের দু্যতিতে লেখা হয়ে যায় আনন্দ ও আগ্রহ৷ কার চোখ? কার হস্তাক্ষর? আমি এখানে বুদ্ধদেব বসুর চোখ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তাক্ষরের কথা বলছি৷ পুত্র যেন শিশুর চিঠিতে চোখ রেখেছে৷ পিতার অক্ষর আর পুত্রের চোখ একই জায়গায় এসে মিলেছে৷ তখন ১৯৩৫ সাল৷ বুদ্ধদেব প্রকাশ করেছেন সেই বিখ্যাত কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যা, যে পত্রিকাটি ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছাবি্বশ বছর ধরে নির্মাণ করে গেছে, সেই কাব্য সংস্কৃতি যাকে আমরা আধুনিকতাবাদী বলে থাকি৷ পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধদেব একটি কপি পাঠিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের কাছে৷ তিনি দ্রুত পড়ে ফেলেন পত্রিকাটি৷ একটা চিঠিও পাঠান বুদ্ধ দেবকে৷ চিঠিটার মূল সুরের একটা সংক্ষিপ্ত চরিত্রায়ন এভাবে দাঁড় করানো যায় : সাবাশ, পুত্র! পিতার চিঠি পেয়ে পুত্র অবশ্যই আনন্দিত হয়৷ মাঝে মাঝে এমনকি নিজেকে বৈধ করার জন্য বা নিজের কথা বলার জন্যই অবাধ্য বা বিদ্রোহী পুত্ররাও পুরুষতন্ত্রের পেশি ফুলিয়ে পিতাকে নিয়ে অহংকার করে থাকে৷ বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একাধিকবার অহংকার করেছেন; আবার রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতাও করেছেন৷ কিন্তু ওই চিঠি প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের দৃষ্টি কেড়েছে রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষর৷ বুদ্ধদের তার প্রতিক্রিয়া জানান দেন এভাবে : ‘মস্তএকখানা তুলোট কাগজের এপিট-ওপিঠ ভর্তি সেই অনিন্দ্য সুন্দর হস্তাক্ষর, যার তুলনা আমি দেখেছিলাম বহুকাল পরে অক্সফোর্ড এবং প্রদর্শনীতে টেনিসন ও রবার্ট ব্রিজেস-এর পাণ্ডুলিপিতে৷’

তার হস্তাক্ষর-মুগ্ধতার বয়ান উপস্থিত করার জন্য বুদ্ধদেবকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অক্সফোর্ডের ওই প্রদর্শনীর জন্য, যেখানে তিনি আবিষ্কার করেন এমন এক তুলনা যার অভিমুখ পশ্চিম_ সেখানে থাকেন টেনিসন ও ব্রিজেস-এর মতো ইংল্যান্ড-মুগ্ধ ইংরেজ কবিরা৷ বুদ্ধদেব বসু নিজেই প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানভাবেই তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার চর্চা করেছেন৷ তুলনা করা তার অভ্যাস বটে৷ মাঝে মাঝে তিনি হুটহাট করে এর সঙ্গে ওর তুলনাও করেন৷ তুলনামূলক সাহিত্যে বেশ সময় ধরে প্রশিক্ষিত হওয়ার সুবাদে আমি নিজেই টের পেয়ে যাই যে, গ্যেটের পথ ধরে এগুনো তুলনামূলক সাহিত্য চেহারায় ও চরিত্রে ইউরোপকেন্দ্রিক আর বুদ্ধদেব বসুরা তুলনামূলক সাহিত্যের যে ধারা তৈরি করেছিলেন তা প্রায় সর্বাংশেই পশ্চিমাকেন্দ্রিক, যে কেন্দ্রিকতার পেছনে কাজ করেছে এক ভুয়ো ‘আন্তর্জাতিকতাবাদ-এর দোহাই আর যে-আন্তর্জাতিকতাবাদ স্বভাবতই উপনিবেশবাদের যুগে জাতীয় সংস্কৃতির নির্মাণের প্রয়োজনীয়তাকে প্রায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে৷ চামড়ার রঙ বাদামি, কিন্তু সাদা মুখোশ পরা চাই’_ এমনি এক তাগিদই তো রবীন্দ্রনাথকে হুট করে টেনিসনের আর ব্রিজেসের কাতারে আনতে চায়৷ এতে রবীন্দ্রনাথ জাতে ওঠে? নাকি এর নাম বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব? নাকি এর নাম আত্মনিরাপত্তাহীনতা? আর বিশ্ব মানেই কি পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র অংশ যার নাম ইউরোপ? প্রশ্নগুলোতে আমরা পরে ফিরে যাব৷ কিন্তু তার আগে এখানে এও বলে নেয়া প্রয়োজন যে, তুলনামূলক সাহিত্যের এলাকা নিঃসন্দেহে বুদ্ধদেব বসুর কাজের সমগ্রের একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র এবং এই অংশের নিরিখে বুদ্ধদেবের সামগ্রিক মূল্যায়নও আমার উদ্দেশ্য নয় মোটেই৷ ওকে লালন ফকিরের গান থেকে বের করে আনা একটা ইঙ্গিতও মনে ধরে : কোন তুচ্ছ অংশেও সমগ্রের ইশারা বা আভাস পাওয়া যেতে পারে৷ হুট করে মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া কোন খণ্ড উচ্চারণ কিংবা কোন ছোট বা ছেঁড়া চিরকুটে লেখা মন্তব্য কিংবা কারও সম্পর্কে কোন তাত্‍ক্ষণিক ধারণাও এমন কিছু বয়ান বা জ্ঞানভাষ্য তৈরি করতে পারে, সেখানে একজন লেখকের মনোগঠনের আকিবুকি খানিকটা পড়া যেতে পারে৷ এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই আমি বর্তমান রচনায় বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনামূলক কাজের কয়েকটি দিক নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা হাজির করতে চাই৷

২.

আমার নির্দিষ্ট কিছু জিজ্ঞাসাসহ কয়েকটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ হাজির করার আগে বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যিক ও নানন্দনিক তত্‍পরতা এবং অবদান নিয়ে কিছু কথা বলে নিতে চাই৷ প্রথমত, বুদ্ধদেব বসু যথার্থই একজন সব্যসাচী লেখক৷ বলা যাবে, সব্যসাচী লেখক হয়ে ওঠার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন আজীবন৷ পিতার অনুকরণেই কিন্তু পিতার সঙ্গে পালা দিয়েই যেন এগিয়ে যেতে চেয়েছে৷ আমি পিতা বলতে রবীন্দ্রনাথকে বোঝাচ্ছি; পুত্র তো বুদ্ধদেব বসু নিজেই৷ পিতা-পুত্রের টানাপড়েন, সংঘর্ষ ও ঐক্যের প্রসঙ্গগুলোকে নিদেন পক্ষে রূপকার্থে চালু করার ভেতর দিয়ে আমি অবশ্য বুদ্ধদেবের অপরীক্ষিত আধুনিকতাবাদের পুরুষতান্ত্রিক চেহারাটাও খানিকটা দেখে নেয়ার চেষ্টা করছি৷ কিন্তু না, বিস্তারের দিক থেকে পুত্র পিতাকে টপকাতে পারেনি৷ তারপরও বুদ্ধদেবের সাহিত্যিক বিস্তারের কথা বেশ জোরেশোরে বলতে হয় : কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটকও লিখেছেন, সমালোচনাও হাজির করেছেন, নিবন্ধ লিখেছেন, চিঠিও লিখেছেন প্রচুর, রম্যরচনাও পাওয়া গেছে তার কাছ থেকে৷ এছাড়া তো রয়েছে বিদেশী সাহিত্য, বিশেষ করে ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে তার সাড়া জাগানো প্রভাবশালী অনুবাদ৷ সংস্কৃত সাহিত্য থেকেও অনুবাদ করেছেন তিনি; বিশেষভাবে উলেখ করা যাবে কালিদাসের মেঘদূত-এর কথা৷ তুলনামূলক সাহিত্যের এলাকাতেও তার কাজ আছে, যে কথা আগেই বলেছি৷ আমার এই সংক্ষিপ্ত বয়ানেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, বুদ্ধদেব একজন সব্যসাচী লেখক৷ এও বলা দরকার, কেবল ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যেই বুদ্ধদেব লিখেছেন নিদেনপক্ষে ৮৫টি বই এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে বেরিয়েছে আরও ৬৫টি বই৷ ১৯৭৪ সালে তার মৃতু্যর পর প্রকাশিত বইগুলো না হয় বাদই দিলাম৷ যেমন তিনি বহুপ্রজ লেখকও বটে৷

কিন্তু সব্যসাচী ও বহুপ্রজ লেখক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর তত্‍পরতার কথা বলাটাই যথেষ্ট নয়৷ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যা ভীষণভাবে তাত্‍পর্যপূর্ণ হয়েছে, সে বিষয়টিও সামনে আনতে হয়৷ তা হচ্ছে বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবশালী সাহিত্যিক-সাংগঠনিক তত্‍পরতা যার অনুপস্থিতিতে বোধ করি বাংলা কবিতার চেহারা ও চরিত্র অন্যরকম হতে পারত৷ হঁ্যা, বিশেষ দশকে ঢাকা থেকেই শুরু হয়েছে তার সাংগঠনিক তত্‍পরতা৷ এই তত্‍পরতার আবার তিটি মাত্রা অনায়াসেই শনাক্ত করা যায় : সম্পাদনা, সমালোচনা ও প্রকাশনা৷ ঢাকায় থাকাকালীন বুদ্ধদেব বসু সম্পাদনা করেন দুটি পত্রিকা : ১৯২২ সালে প্রকাশিত জগন্নাথ হলের বার্ষিকী বাসন্তিকা এবং ১৯২৭ সালে কবি অজিত দত্তের সঙ্গে তার যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা প্রগতি৷ এরপর কলকাতায় ১৯৩৫ সাল থেকে শুরু হয় বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত ত্রৈমাসিক কবিতার ভীষণ প্রভাবশালী সাহিত্যিক বাঁক চিহ্নিত অভিযাত্রা, যার সমান্তরাল বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসেই অনুপস্থিত৷ ফরাসি তাত্তি্বক পিয়ের বুরদো যাকে বলেছিলেন ‘বিপণনের প্রতীকী লজিক, যা নিমিষেই নান্দনিকতার ঝলমলে পোশাক পরে নিতে পারে, তাই যেন ঠিকঠাক বুঝে গিয়েছিলেন কবিতা পত্রিকার ওই সম্পাদক, যিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এই কথাটা : লেখাটাই যথেষ্ট নয়; দরকার তার বৈধতা ও ক্ষমতা৷ এক অর্থে আধুনিকতাবাদকে বৈধ ও ক্ষমতাশালী করার ক্ষেত্রে কবিতা পত্রিকাটির ঐতিহাসিকভাবে তাত্‍পর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ ওই কবিতা পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় যারা বুদ্ধদেব বসুকে সহায়তা করেছেন, তারা হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, নরেশ গুহ, প্রতিভা বসু এবং এমনকি কবি সমর সেন৷ ওই কবিতা পত্রিকা ছাড়াও ১৯৩৮ সালে বুদ্ধদেব বসু আবার হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে যৌথভাবে বের করেন চতুরঙ্গ নামের একটি পত্রিকা৷ পরে অবশ্য বুদ্ধদেব বসু ওই পত্রিকা থেকে সরে আসেন৷

এবার কবিতা পত্রিকা নিয়ে দু’একটা কথা বলা যাক৷ এই পত্রিকার ভেতর দিয়েই বুদ্ধদেব বসু বিভিন্ন সৃজনশীল লেখকের শুধু তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিকে আরও তৃষ্ণার্তই করেননি; তিনি এক ধরনের মতাদর্শিক আধিপত্যও তৈরি করেছিলেন বটে৷ এই পত্রিকার পাতাতেই বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য নিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েই সমালোচনা করেছেন; যেমন তিনি লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবতর্ী প্রমুখ সমকালীন কবিদের নিয়েও৷ তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী কবি হিসেবেও যাদের চিহ্নত করা হয়, যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত, নিশিকান্তপ্রমুখ, তাদের নিয়েও লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু৷ যতীন্দ্রনাথ ও নজরুল তো রয়েছেনই৷ এমনকি ‘বামপন্থী’ কবি হিসেবে পরিচিত সুভাষ মুখাপাধ্যায় ও সমর সেন নিয়েও লিখেছেন তিনি, যেমন লিখেছেন তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও৷ এভাবে কবিতা প্রকাশ করার পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসু নিজেই সাহিত্য সমালোচনার একটি চেহারা ও চরিত্র দাঁড় করিয়েছেন৷

এও লক্ষ্য করা দরকার যে, ১৯৩৫ সালে শুরু হয় কবিতা পত্রিকাটির অভিযাত্রা৷ ওই একই সালে ইউরোপের সাহিত্যেও বেশ চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়, কেননা ওই সালেই বের হয় ইয়েটসের বিখ্যাত এ ফুল মুন ইন মার্চ, এলিয়টের নাটক মার্ডার ইন ক্যাথিড্রেল, মার্কিন আধুনিকতাবাদী দুই কবি ওয়ালেস স্টিভেন্স এবং উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে আইডিয়াস অব অর্ডার এবং অ্যান আলি মারটার অ্যান্ড আদার পোয়েমস৷ এছাড়া দু’জন গ্রিক কবি কনস্তানতিন কাভাফি ও গিয়োগোর্স সেফেরিস-এর কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে টেল অব লেজেন্ডস এবং পোয়েমস অব সিংপি কাভাফি প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালেই৷ আরও যুক্ত হয় মার্কিন নিরীক্ষাধমর্ী নকশা-মকশো করা, ক্রীড়াপ্রবণ, লিরিক কবি ই. ই. কামিংস-এর নো থ্যাঙ্কস৷ এখানে এও উলেখ করা দরকার যে, ১৯৩৩ সালে স্পেন ঘুরে এসে স্পেন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ১৯৩৫ সালে কবি আলামা ইকবাল বের করেন তার কাব্যগ্রন্থ বাল-ই-জিব্রিল; আর অন্যদিকে স্পেনের কবি লোরকা ওই একই সালে প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত সিক্স গ্যালিশিয়ান পোয়েমস৷ এভাবে ১৯৩৫ সাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে৷

কিন্তু কবিতা পত্রিকার ভেতর দিয়ে কী ধরনের সাহিত্য-সমালোচনা দাঁড় করালেন বুদ্ধদেব বসু? প্রথমত বলে নেয়া দরকার যে, একজন কবির বা কথাসাহিত্যিকের ক্ষমতা ও খানিকটা কারিগরি দক্ষতাকে দ্রুত শনাক্ত করতে পারতেন বুদ্ধদেব বসু; এর প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যাবে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার সমালোচনার কাজকে যেমন, তেমনি নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবতর্ী ও বিদেশীদের মধ্যে বিশেষ করে বোদলেয়রকে নিয়ে তার কাজকেও সামনে আনা যাবে, যদিও নজরুল ও বোদলেয়রের স্বভাব ও চিহারাকে একাধিক পরিসরে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন বুদ্ধদেব বসু৷ এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘প্রচুর লেখা উপহার দেয়া সত্ত্বেও তিনি পুতুপুতু রাবিন্দ্রকতাকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, প্রায় ততটাই তিনি এড়িয়ে গেছেন সেই রবীন্দ্রনাথকে যিনি ইতিহাসে মানুষের স্থান, ঐতিহাসিকতার সঙ্গে সামাজিকতার সম্পর্ক, পুবের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক, শিক্ষার অর্থ ও স্বরূপ, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এক ধরনের চিন্তার লিপ্ততার প্রমাণ রেখেছেন৷ এসব প্রসঙ্গে পরে ফেরা যাবে৷ তবে বুদ্ধদেবীয় সমালোচনার ধরন নিয়ে দু-একটা পর্যবেক্ষণ হাজির করা যাক৷

হঁ্যা, কোন একজন লেখককে নিয়ে যখন বুদ্ধদেব বসু আলোচনা করেন, তখন একজন লেখকের কাজকে যতটা তিনি ভাষিক ঘটনা হিসেবে দেখেন, ততটা তিনি তাকে জাগতিক ঘটনা হিসেবে দেখেন না৷ এতে মনে হয় যে, ভাষা যেন উড়াল দিয়ে বইয়ের পাতার হরফে হাজির হয়েছে৷ জগতের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে কিংবা ভাষার জাগতিকতা ও জগতের ভাষিকতা নিয়ে, মাথা ঘামাবার সময় ছিল না বুদ্ধদেব বসুর৷ কিন্তু আবার ভাষিক ঘটনা হিসেবে একটি সাহিত্যিক কাজকে যখন তিনি বিবেচনায় রাখেন, তখন আবার ভাষার ঘনিষ্ঠ পঠনের দিকেও যে তিনি অগ্রসর হয়েছেন তা বলা যাবে না৷ বরঞ্চ একটি কাজ নিয়ে বা তার ভাষা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু তার অনুভব ও অভিজ্ঞতাকে প্রশয় দিয়েছেন এবং তাদের পক্ষে উদাহরণও জড়ো করেছেন৷ আবার সাহিত্যের বা ভাষার ইতিহাসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাঠ করার ভেতর দিয়ে কোন একটি সৃজনশীল কাজের স্বরূপ উদঘাটনেও বুদ্ধদেবের আগ্রহ প্রায় শূন্য ছিল বলেই চলে৷ অন্য কথায়, বুদ্ধদেব ইঙ্গ-মার্কিন ‘নিউ ক্রিটিসিজম্-এর সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাস-বিমুখতাকে সঙ্গে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার বিশেষণী পদ্ধতিকে নয়৷ আবার কোন গভীর সংশেষণের দিকে যে তিনি অগ্রসর হয়েছেন, তাও বলা যাবে না৷ তিনি বিশেষণীও নন, সংশেষণীও নন৷ বরঞ্চ তিনি খানিকটা যুক্তির চালেই নির্ভর করেছেন ‘ইমপ্রেশান’-এর ওপর৷ তার সমালোচনামূলক কাজে ওই ‘ইমপ্রেশান’-এর বিস্তারই লক্ষ্য করা যায়, যদিও তিনি থেকে থেকে নিজের মতো করেই উদাহরণ জড়ো করতে ভুলেন না৷ এভাবে এও ধরা পড়ে যে, পশ্চিমা মুলুকের ‘বেল-লেত্রিস্ত্’ ঐতিহ্যের একটা বড় আছর পড়েছিল বুদ্ধদেব বসুর ওপর৷ অর্থাত্‍ পাশ্চাত্যমুখী বুদ্ধদেব বসু পাশ্চাত্যের ‘নিউ ক্রিটিসিজম্’-এর সঙ্গে পুরোপুরি তাল মিলাতে সক্ষম না হলেও তার খানিকটা অাঁকড়ে ধরে ওই ‘নিউ ক্রিটিসিজম্-এরও আগের যুগে ফিরে যেতে চেয়েছেন৷

আর এভাবেই বুদ্ধদেব বসু তার গদ্যও তৈরি করেছিলেন_ এমন এক গদ্য যা নিঃসন্দেহে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্য দারুণভাবে পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছে, যে-গদ্য তরতর করে বয়ে চলে, যাকে আবার কেউ কেউ ‘মিষ্টি গদ্যও’ বলেছেন বটে৷ তার রম্যরচনার গদ্যের সঙ্গে আসলেই তার সমালোচনার গদ্যের তেমন পার্থক্য চোখে পাড়ে না৷ সত্য, এই গদ্য দিয়ে একাধিক কাজ করা সম্ভব বটে৷ তা করেছেনও বুদ্ধদেব বসু৷ কিন্তু এ-গদ্যে চিন্তার প্রাখর্য্য কিংবা বিশেষণের তীব্রতা বা প্রশ্নের রাজনৈতিকতা জমে উঠে না৷ সেগুলো অবশ্য বুদ্ধদেবের অভীষ্ট ছিল না৷ কিন্তু তিনি যা করেছেন তাতে আমরা আয়েশি গদ্যফাঁদা এমন একজন সমালোচককে পাই, যিনি আমাদের চিন্তাকে ঘুম পাড়াতেই ব্যস্ত, জাগাতে নয়৷ সমালোচনার ইহজাগতিক উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রশ্ন তোলার ভেতর দিয়ে কিংবা অপরীক্ষিত বা উপেক্ষিত অঞ্চলকে দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে বিরাজমান ব্যবস্থা বা ক্ষমতা-সম্পর্ককে ধাক্কা দেয়া বা তাকে এমনকি ভেঙে ফেলা৷ আবার সমালোচনা বলতে কেবল মূল্যায়ন বা বিশেষণকেই বোঝায় না; সমালোচনা হচ্ছে চিন্তাশীল সাংস্কৃতিক অনুশীলন যা বিরাজমান অসম ক্ষমতা সম্পর্কের কাঠামোর সঙ্গে বিভিন্নভাবেই বিরোধে জড়িয়ে থাকে৷ বলা বাহুল্য, ‘বেল-লেত্রিস্ত’ ঐতিহ্যের অনুসরণেই এবং নান্দনিকতার এক বিশেষ মতাদর্শিক টানেই বুদ্ধদেব বসু সমালোচনাকে প্রকৃত অর্থে বাংলার উপনিবেশপীড়িত জীবনের ছন্দঃস্পন্দে জারিত করে তাকে চিন্তার ঘাম-ঝরানোর এবং রক্তপাতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি৷ সত্য সাহিত্যের বিভিন্ন এলাকায় ও মাধ্যমে তিনি প্রায় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন, যে-কথাটা আগেই বলেছি৷ কবিতা ও সমালোচনা ছাড়া তিনি লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনী ও শিশুকিশোর সাহিত্য৷ এসব সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসু সমালোচনার এলাকায় এসে বেশ সীমিত হয়ে পড়েন৷ কারণ জীবন মানেই কেবল নান্দনিকতা, ভাষিকতা ও ব্যক্তিকতা নয়৷

বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনামূলক কাজ নিয়ে আরও কয়েকটি কথা বলে নেয়া দরকার৷ এখানে তাহলে নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর সেই বিখ্যাত আলোচনার প্রসঙ্গটাই চলে আসে৷ অস্বীকার করার জো নেই যে, বেশ গুরুত্বসহকারেই নজরুলের কবিতাকে সামনে এনেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, চিহ্নিত করছিলেন নজরুলের কাব্যশক্তি৷ বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পর সবচেয়ে যে বড় কবিত্বশক্তি নজরুল ইসলামের৷’ তবে বুদ্ধদেব বসুকে জুড়ে দিতে হল ওই সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথাও৷ এবং তার তর্জনী-নির্দেশে একধরনের হায়ারার্কিও নির্দিষ্ট হল৷ কিন্তু কেন এই হায়ারার্কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতেও রাজি নন বুদ্ধদেব বসু৷ এরপর বুদ্ধদেব বসু নজরুলের কবিতায় ‘হৈ চৈ’-কে অনান্দনিক ঠাওরিয়ে নজরুলের গদ্যে তার ‘অতিমুখর মনের অসংযত বিশৃঙ্খলা’ চিহ্নিত করে শরণাপন্ন হন ইংরেজ ‘রোমান্টিক’ কবি বায়রনের৷ হুট করেই যেন নজরুলের সঙ্গে বায়রনের তুলনা করে বসেন বুদ্ধদেব বসু৷ তিনি মোটেই বিবেচনায় রাখেন না যে, বায়রন একজন রেজ অভিজাত, বিদ্রূপপ্রবণ, সনাতন-সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া কবি আর অন্যদিকে নজরুল একেবারে গ্রামীণ প্রোলেতারিয়েত থেকে উঠে আসা একজন বিদ্রোহী কবি; যার গায়ে লেগে থাকে বাংলার মাটি-কাদা-জলের চিহ্ন ও গন্ধ, যা থেকে অবশ্য বুদ্ধদেব বসু সরিয়ে রাখেন তার নান্দনিক ইন্দ্রিয়৷ কিন্তু বায়রনের সঙ্গে নজরুলের তুলনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেন না বুদ্ধদেব বসু৷ গ্যেটের রবাত দিয়ে আবার এও বোঝান যে, চিন্তা করতে গিয়ে নজরুলের অবস্থা হয় একজন শিশুর মতো৷ (যেমন গ্যেটের বিবেচনায় ওই একই অবস্থা হয় বায়রনেরও)৷ এখানে বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব তুলনামূলক চিন্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে বটে৷ তবে তুলনার জন্য বা নান্দনিক উত্‍কর্ষের মাপকাঠির জন্য পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিষ্ঠানিকভাবেও উদযাপিত লেখকদের দ্বারস্থ হওয়াটা বুদ্ধদেব বসুর পক্ষে স্বাভাবিকই বটে, কেননা যে-বিদেশী সাহিত্যে ও সাহিত্য সমালোচনায় বুদ্ধদেব বসু প্রশ্নহীনভাবে বিচরণ করেছেন সেগুলো ছিল তুমুলভাবে ইউরোপকেন্দ্রিক৷ আর ‘শিশু’ বলতে বুদ্ধদেব বসু কি বুঝিয়েছেন তার কোন ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না তার কাছ থেকে৷ অন্যদিকে আবার পরিপক্বতা বা ‘প্রগতি’ আসলেই কী বস্তু তার ওপর কোন আলো ফেলেন না তিনি৷ তাহলে কি অন্তত ধরে নেব যে, পরিপক্বতা কিংবা সাবালকত্ব মানে ‘হৈ চৈ’ না করা? বা তার মানে কি বুদ্ধদেব বসুর মতো পশ্চিমা উপনিবেশবাদ নিয়ে কোন প্রশ্ন না তুলে বরঞ্চ লেপের নিচে বৃষ্টির রাতে আরাম করে পড়া যায় এমন এক মিষ্টি গদ্যে বা কবিতায় অনুভব ও অভিজ্ঞতাকে বাজিয়ে নেয়া৷
নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনায় এও লক্ষ্য না করে উপায় নেই যে, তিনি নজরুলের চরিত্রায়নে ‘শিশু’ দিয়ে শুরু করে ‘বালক’-এ উপস্থিত হয়েছেন৷ নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর সেই পুরনো উক্তিটাকে সামনে আনতে বাধ্য হচ্ছি৷ বুদ্ধদেব বলছেন, ‘পঁচিশ বছর ধরে প্রতিভাবান বালকের মতো লিখেছেন তিনি, কখনো বাড়েননি, বয়স্ক হননি, পর পর তার বইগুলোতে কোনো পরিণতির ইতিহাস পাওয়া যায় না, কুড়ি বছরের লেখা তার চলিশ বছরের লেখা একই রকম৷’ একেবারেই একই রকম? আঙ্গিক থেকে বিষয়বস্তু পর্যন্তসবই একই রকম? বিদ্রোহী কবিতার চেহারা ও চরিত্রের সঙ্গে তার বিভিন্ন ধরনের কবিতার চেহারাকে এক করে দেখা যায়? ‘বাড়েনি’ কথাটিরই বা অর্থ কী? এসব প্রশ্ন আজও প্রশ্ন থেকে যায়, কেননা প্রশ্নগুলোর কোনো মীমাংসা নেই বুদ্ধদেবের ওই আপাত আগ্রহতাড়িত আলোচনায়৷ এও লক্ষ্য করা দরকার যে, নজরুলের পুরো কাব্যকর্মের ওপর_ পঁচিশ বছরের কাজের ওপর_ বুদ্ধদেব বসু এক চূড়ান্তফতোয়া জারি করেছেন, যাকে বর্তমান সময়ের নিরিখে আবারও খতিয়ে দেখা দরকার৷ জানি, নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনাকে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনেকেই বাহবা দিয়েছেন৷ এও জানি, নজরুলের প্রতি বুদ্ধদেব বসুর একটা বিশেষ টানও ছিল; নজরুলকে নিয়ে তিনি বিশেষ সংখ্যাও করেছেন বটে৷ কিন্তু ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর নজরুল ইসলাম শীর্ষক সমালোচনামূলক রচনাটি খেয়াল করে বার বার পাঠ করলে ধরা পড়ে, রচনাটি আসলে ‘ব্যজস্তুতির একটি বিশেষ ঐতিহাসিক নমুনা৷ আর এই ‘ব্যজস্তুতি’ হচ্ছে প্রশংসাচ্ছলে নিন্দা৷

আবারও ফেরা যাক বুদ্ধদেব চিহ্নিত নজরুলের ‘হৈ চৈ’ প্রসঙ্গে৷ তার সঙ্গে ‘রুচি’র প্রশ্নেও, যে প্রশ্নটি নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বেশ ভাবিত৷ লক্ষ্য করা যাক বুদ্ধদেব বসুর এই মন্তব্যটি : ‘নজরুল চড়া গলার কবি, তার কাব্যে হৈ চৈ অত্যন্ত বেশি এবং এই কারণেই তিনি লোকপ্রিয়৷ যেখানে তিনি ভালো লিখেছেন, সেখানে তিনি হৈ চৈটাকেই কবিত্বমণ্ডিত করেছেন : তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনায় দেখা যায়, কিপলিঙের মতো, তিনি কোলাহলকে গানে বেঁধেছেন৷’ এই সংক্ষিপ্ত বয়ানটির একটি মনোযোগী পঠনে বেশ কয়েকটি বিষয় বেরিয়ে আসে৷ প্রথমেই প্রশ্ন জাগে : নজরুল কি কেবলই চড়া গলার কবি? এছাড়া গলা চড়ানোর বিষয়টি যে ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্বে সাংস্কৃতিকভাবেই অনিবার্য হয়ে ওঠে, যখন নান্দনিকতার প্রশ্নটিও ঐতিহাসিকতার উত্তাপে গলে যায় রাজনীতিতেই, সেই বিষয়টি বুঝিয়ে বলাটা বুদ্ধদেবের পক্ষে একেবারেই সম্ভব হয়নি৷ এভাবে বিদ্রোহী নজরুলকে তিনি একেবারেই চিনতে পারেননি৷ বুদ্ধদেবের আলোচনায় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে অবশ্য খানিকটা প্রশংসামূলক মন্তব্য পাওয়া যায়৷ কিন্তু ওই কবিতায় নজরুল কি বলতে চাচ্ছেন এবং কেন তার কণ্ঠস্বর সেখানে উচ্চকিত হচ্ছে, সেই সব প্রশ্নকে একেবারেই এড়িয়ে গিয়ে নজরুলের তাত্‍পর্যকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন বুদ্ধদেব বসু৷ এবার আসা যাক দ্বিতীয় বিষয়টিতে৷ উদ্ধৃত মন্তব্যটি বলে দেয় যে, হৈ চৈ-এর কারণে, বা ‘হৈ চৈ’কে কবিত্বমণ্ডিত না করার কারণে, নজরুলের অধিকাংশ রচনা একদিকে যেমন কাব্যের পর্যায়ে উন্নীত হয় না, অন্যদিকে তেমনি আবার তা লোকপ্রিয় হয়৷ অর্থাত্‍ বুদ্ধদেবের কাছ থেকে এমনি একটা ইঙ্গিত বেরিয়ে আসে : সর্বসাধারণ হৈ চৈ বোঝে কিন্তু কাব্য বোঝে না৷ হঁ্যা, সত্য, বুদ্ধদেব বসুদের কাব্য আসলেই জনগণের জন্য নয় (কেননা জনগণ ‘অশিক্ষিত’, ‘অনান্দনিক’)৷ তৃতীয়ত, বুদ্ধদেব বসু নজরুলের ‘শ্রেষ্ঠ রচনা’র কথাও বলেন, যেখানে ওই ‘হৈ চৈ’ কবিত্বমণ্ডিত৷ কিন্তু নজরুলের শ্রেষ্ঠ রচনার কথা বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু টেনে আনেন কিপলিঙকে৷ কবি আর পেলেন না বুদ্ধদেব বসু! নজরুলের শ্রেষ্ঠত্বকে বোঝাতে গিয়ে একেবারেই ভিন্ন মতাদর্শের ও স্বভাবের কবি কিপলিঙকে টেনে আনলেন, যে কিপলিঙকে জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পয়গম্বর’, যে কিপলিঙ আবার নিজেই বলেছেন, সাদা মানুষের ‘বার্ডেন’-এর কথা৷ এই কিপরিঙ-এর সঙ্গে নজরুলের তুলনাকে আসলেই হাস্যকর মনে হয়৷ শুধু হাস্যকরই নয়, এই তুলনা মোটেই নিরীহ নয়৷ উদ্ধৃত মন্তব্যসহ বুদ্ধদেব বসুর সমস্তআলোচনাটা বিবেচনায় রাখলে ধরা পড়ে যে, একটি উপনিবেশায়িত মন নিয়েই বুদ্ধদেব বসু নজরুলের মতো একটি তীব্র উপনিবেশবাদবিরোধী কবির পঁচিশ বছরের কাজকে বিচার করতে বসেছেন৷ আর বুদ্ধদেবের মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে গ্যেটে-বায়রন-কিপলিঙ৷

এবার আসি ‘রুচি’ প্রসঙ্গে৷ নজরুলের বিরুদ্ধে তার গানের প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু সরাসরি রুচিহীনতার অভিযোগ তোলেন৷ তবে এও সত্য যে, নজরুলের গানের বেশ প্রশংসা করেছেন বুদ্ধদেব বসু৷ তিনি বলেন, ‘গানের ক্ষেত্রে নজরুল নিজেকে সবচেয়ে সার্থকভাবে দান করেছেন৷ তাঁর সমগ্র রচনাবলির মধ্যে স্থায়িত্বের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তার গানের৷’ কিন্তু এই মন্তব্যের কিছু পরে বুদ্ধদেব বসু এও বলেন, ‘কিছু কিছু রচনা পাওয়া যাবে, যাকে অনিন্দ্য বললে অত্যন্ত বেশি বলা হয় না৷’ আরও বেশি গান যে অনিন্দ্য হয়নি, তার কারণ নজরুলের দুরতিক্রম্য রুচির দোষ৷ কত গান সুন্দর আরম্ভহয়েছে, সুন্দর চলে এসেছে, কিন্তু শেষ স্তবকে কোন একটা অমার্জিত শব্দ প্রয়োগে সমস্তজিনিসটিই গেছে নষ্ট হয়ে৷ ভুরভুর করে বেরিয়ে আসে বুদ্ধদেব বসুর ‘এলিটিজম’৷ আর উদাহরণ ব্যতিরেকে যখন বুদ্ধদেব বসু এই ভাষায় কথা বলতে থাকেন, তখন মনে হয় যে, তিন ‘রুচির’ একচ্ছত্র এজেন্সি নিয়েছেন৷ আর এই ‘রুচি’ বিষয়টি বা কী? কে ঠিক করে দেবে কোনটি রুচিশীল আর কোনটি নয়? ‘অমার্জিত’ শব্দ বলতেই বা কী বোঝায়? এসব প্রশ্ন কেবল আমার নয়৷ প্রশ্নগুলো অন্য পরিসরে তুলেছেন বুদ্ধদেব বসুরই সমসাময়িক ‘তৃতীয় বিশ্বে’-এর একদল কবি৷ বিশেষভাবে উলেখ করা যাবে চিলির কবি পাবলো নেরুদা, ক্যারিবীয় কবি এমে সেজেয়ার আর আফ্রিকি-মার্কিন কবি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর গড়ে ওঠা তৃতীয় বিশ্বের কবি) ল্যাঙস্টন হিউস-এর কথা৷ বলা দরকার, নেরুদা তার ‘পোয়েটিকস অব দ্য ইমপিউর’ নামের এক ইশতেহারধমর্ী রচনায় ভর্ত্‍সনা করছেন তাদের, যারা কথায় কথায় ‘রুচি’, ‘অমার্জিত’, ‘স্থূল’, ‘অসংস্কৃত’ ইত্যাদি চিহ্নায়কগুলো ব্যবহার করে থাকেন৷ কিন্তু এসব কবির সঙ্গে বোধগম্য কারণেই বুদ্ধদেব বসুর কোনো আত্মীয়তা হয়নি; বরঞ্চ তার আত্মীয়তা স্থাপিত হয়েছে সাদা কবিদের সঙ্গে যাদের বিবেচনার নিরিখে বা মানদণ্ডে বুদ্ধদেব বসু ঠিক করে দেন কোনটি ‘মার্জিত’ আর কোনটি ‘অমার্জিত’, কোনটি ‘কাব্যিক’ আর কোনটি ‘অকাব্যিক’? অবশ্যই বলা যাবে যে, উপনিবেশবাদের সুবাদে আসা তিরিশি আধুনিকতাবাদ যে নান্দনিক উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল জোরেশোরে, সেখানে বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকা থাকে প্রধানই৷

৩.

কিন্তু নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনা প্রসঙ্গে এতটা সময় খরচ করা হল কেন? বুদ্ধদেব বসু আমাদেরকে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা উপহার দিয়েছেন বটে, কিন্তু কেবল নজরুল সংক্রান্তআলোচনা দিয়েই কি বুদ্ধদেবকে বোঝার উপায় আছে? আগেই বলেছি, বুদ্ধদেব বসুর সামগ্রিক মূল্যায়ন আমার এই রচনার উদ্দেশ্য নয়; সেটি বর্তমান রচনার পরিসরে সম্ভবও নয়৷ তবে নজরুলকে নিয়ে বুদ্ধদেবের আলোচনাকে গুরুত্ব দেয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে৷ প্রথমত, মতাদর্শিক দিক থেকে নজরুল ইসলাম বুদ্ধদেব বসুর একজন বিশেষ ‘অপর’৷ দ্বিতীয়ত, এই অপরকে দেখার ক্ষেত্রে সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ কার্যকর থাকে, যে চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে একজন আলোচকের ধ্যানধারণা বা চিন্তাভাবনা একটি বিশেষ মতাদর্শিক অবয়ব লাভ করে, যার দিকে তাকিয়ে ওই আলোচকের চেহারা ও চরিত্র খানিকটা চিনে নেয়া যায়৷ তৃতীয়ত, বুদ্ধদেব বসু নজরুল ইসলামকে নিয়ে কথা বলেছেন এমন এক সময় যখন বুদ্ধদেব বসুর একটি নান্দনিক মতাদর্শিক ফ্রেমওয়ার্ক বেশ দাঁড়িয়ে গেছে৷ বিখ্যাত কালো তাত্তি্বক ডবিউ.ই.বি ডুবয়েসের একটা কথা মনে আসে, “একজন শাদা ব্যক্তি যখন আরেক শাদার সঙ্গে কথা বলে, সেখানে তাকে যতটা না চেনা যায়, তার চেয়ে বেশি তাকে চেনা যায় যখন সে তার ‘অপর’ একজন কালো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে৷” ডুবয়েসের উক্তিটা বিবেচনায় রেখেই আমার কাছে বুদ্ধদেব বসুর নজরুলবিষয়ক আলোচনাকে একটি ‘উপসর্গিক’ গঠনের যুত্‍সই টেক্সট মনে হয়েছে৷

কিন্তু আমি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়েও কিছুটা কথা বলেছি৷ আরও দু’একটা কথা বলা দরকার৷ এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর কবিতার প্রসঙ্গটা হাজির হয়, যদিও বর্তমান রচনার বিষয়বস্তু কবিতার আলোচনা নয় মোটেই৷ তবে বলা যাবে যে, প্রথম কাব্যগ্রন্থ বন্দীর বন্দনা থেকে সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ স্বাগত বিদায় পর্যন্ত যে অভিযাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার টানাপড়েনের বিভিন্ন চিহ্ন পাঠ করা সম্ভব৷ এবং এও বলা সম্ভব যে, তার কবিতায় রবীন্দ্রবিরোধিতা যেমন আছে কিন্তু কবিতায় বুদ্ধদেব বসু যে ‘লিরিক ব্যক্তিকে’ হাজির করেন এবং চালু রাখেন, সেই ‘লিরিক ব্যক্তি’ নজরুলের যেমন অচেনা, রবীন্দ্রনাথেরও তেমনি৷ এই ব্যক্তির বিশেষ ব্যক্তিকতার জন্ম আসলে নগরায়িত ইউরোপের ঔরসেই৷ এই ব্যক্তি ===== আলোড়িত হয়, অযৌক্তিকতায় ভোগে, কার্যকারণ সম্পর্ককে তোয়াক্কা করে না, নগরের ঝকমকে তকতকে পরিসরে ঘুরঘুর করে, বিয়ার খায় (পারলে মার্কিন হ্যামবারগারও), মগজে ঠাসা পাটিগণিতও বোঝে, নির্মল নীল আকাশ কিংবা অসহ্য সুন্দর দেখে, রান্নাঘরের ধোঁয়ায় হাঁসফাঁস করে, শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে বিছানায়ও যেতে চায়৷ এই ব্যক্তি এমনকি দেখে নেয় কিভাবে উজ্জ্বল আঙুর পৃথিবীর মাটিকে মদির করে চুমো খায়৷ এই ব্যক্তি ‘নিজেকেই খেয়ে সে বেঁচে থাকে৷’ এই ব্যক্তি যতটা না প্রেমে পড়ে, তার চেয়ে, ‘প্রেম’ নামের এক ধারণার সঙ্গে সে প্রেম করে৷ কিন্তু তারপরও এই ব্যক্তি ‘স্পর্শের লাল ফুলের উন্মীলন’-এ বিহ্বল হয়ে ভাষার প্রান্তেউপস্থিত হয়৷ এই ব্যক্তি ‘ডিমের মতো রোদ্দুরও’ দেখে৷ এই ব্যক্তি সংরাগ বোঝে, এমনকি রাগও, কিন্তু এই ব্যক্তি যা বোঝে না তা হল তার ঐতিহাসিকতা, যে ঐতিহাসিকতা জনপদ-আচ্ছন্ন করা কাব্যের, গানের, সরের, ভাবের, দুর্যোগের, বিদ্রোহের৷ অবশ্যই বলা যাবে যে, বুদ্ধদেব বসু তার কবিতায় যে ব্যক্তি হাজির করেন, তা একাধারে ইউরোপায়িত, বিচ্ছিন্ন, অনৈতিহাসিক৷ এই ব্যক্তিই কথা বলে উঠে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় এভাবে : ‘শুধু তাই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত৷’ ওই ব্যক্তি এও বলতে দ্বিধাবোধ করে না : ‘তাই বলি, জগতেরে ছেড়ে দাও, থাক সে যেখানে যাবে,/হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম আর পুলকে বধির৷ যে সব খবর নিয়ে সেবকেরা উত্‍সাহে অধীর/আধ ঘণ্টা নারীর আলস্যে তার ঢের বেশি পাবে৷’ এই ব্যক্তি সেই ব্যক্তি যে উপনিবেশবাদের ভূমি-থেকে উত্‍পাটিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নহীনভাবে উদযাপন করে৷ এই ব্যক্তির দেহ ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে; এই ব্যক্তির ভাষাও ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে৷ অন্য কথায়, এই ব্যক্তির দেহ সংরক্ত হয়ে বস্তুক আয়তন ও অবয়ব লাভ করলেও তা শেষ পর্যন্তভুতুড়েই বটে৷

বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পবিত্র সরকার একটা কথা বলেছিলেন এভাবে : যে কবি বাস্তববাদী নয় সে মৃত৷ কিন্তু যে কবি শুধুই বাস্তববাদী সেও মৃত৷ বাক্যের অদল বদল করে এও বলা যাবে : ‘যে কবি শুধুই বাস্তববাদী সে মৃত৷ কিন্তু যে কবি বাস্তববাদী নয় সেও মৃত৷’ কিন্তু বুদ্ধদেবকে বাঙালি মধ্যবিত্তই বাঁচিয়ে রেখেছে৷ তিনি আছেন তার একাধিক অবদানের কারণেই৷ সব্যসাচী লেখকদের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা৷ আর কবিতার নতুন নির্মাণের স্বার্থেই বার বারই বুদ্ধদেব বসুকে স্মরণ করতে হয়; দেখে নিতে হয় তার প্রভাব কতটা গভীর ও কেন৷

লেখকঃ আজফার হোসেন

বুদ্ধদেব বসু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

……
বন্ধু অজিত দত্তের সঙ্গে ঢাকায়, ১৯২৪
…….

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রথম দশকের ছাত্রদের একজন বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। ঊনিশ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৭ সালে ইংরেজি বিভাগের অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তি হন। চার বছর পর ১৯৩০-এ মাস্টার্স। শুধু সেই আদিকালের নয়, শোনা যায় এতাবৎকালের সেরা ছাত্রদের সেরা তিনি। এমন জনশ্রুতি আছে যে, তিনি ইংরেজি অনার্সে যে মোটনম্বর পেয়েছিলেন, তার রেকর্ড নাকি আজতক কেউ ভাঙতে পারেনি। আমি নিজে ইংরেজি বিভাগের সাথে ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে চার দশকের বেশি জড়িত আছি, কিন্ত ঐ কিংবদন্তীর সত্যতা চেষ্টা করেও, মহাফেজখানার অপ্রবেশ্যতাহেতু, যাচাই করতে পারিনি। তবে একথা ঠিক, বুদ্ধদেব বসুর তুল্য প্রতিভাবান কাউকে ইংরেজি বিভাগ আজ অব্দি সৃষ্টি করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা ছাত্রের শিরোপাও তাঁর প্রাপ্য।

বুদ্ধদেব বসুর কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়া এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। সেটি মোটামুটি সবারই আয়ত্ত। তবু সংক্ষেপে বলি, তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা, যুগস্রষ্টা কবি, নাট্যকার, বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদক, ঔপন্যাসিক ও প্রাজ্ঞ প্রবন্ধকার শুধু নন, তিনি রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাঙালির মননচর্যা ও নন্দনভাবনার উজ্জ্বলতম প্রতিভু। তিনি ছিলেন সেইসব বৈশ্বকোষিক লেখকদের একজন, রবীন্দ্রনাথের পরে এদেশে যাঁরা বিরলপ্রজাতির পাখির মতো দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথের রচনাসম্ভারের বিপুলতার সাথে যদিও তুলনা চলে না, তবু নেহাৎ কম নয় বুদ্ধদেব বসু-র সৃষ্টি। অবিরল ধারায় লিখেছেন তিনি, স্বতঃউৎসারে, গদ্যে-পদ্যে, বাংলায়-ইংরেজিতে; ব্যাখ্যা করেছেন নন্দনতত্ত্ব; লিখেছেন মহাভারতের নবতর ব্যাখ্যা; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা ক’রে তা লালন করেছেন; অসামান্য সব কাব্যনাট্যে বিধৃত করেছেন তাঁর জীবনভাবনা। তাঁর বোদলেয়ার-অনুবাদ অসম্ভব প্রভাবসম্পাতী হয়েছিল, এবং পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এই বাংলাদেশের তরুণ কবিদেরও আঁখি হ’তে ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো; তাঁর উপন্যাস তিথিডোর-এর পাঠকপ্রিয়তা ইদানীংকার সুনীল-সমরেশদেরও ঈর্ষার কারণ হতে পারে।

ফিরে আসি বুদ্ধদেব বসু-র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশের দশকের নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে আসেন নবীন বুদ্ধদেব, তখন তার আজকের দিনের বিপুল বিস্তৃতি ও কোলাহলময়তা ছিল না। শান্ত শহর ঢাকা ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গজিনত হঠাৎ-প্রাপ্তিতে রাজধানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। স্থাপিত হয়েছিল শহরের প্রান্তদেশে, রমনায়, বেশকিছু ইমারত, তার মধ্যে দুটি সুদৃশ্যতম — কার্জন হল এবং পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশের সচিবালয়, যেটি আজকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ। রমনা এবং নীলখেতের ঘনবৃক্ষশোভিত প্রায়-অরণ্যানী অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাজকর্মচারীদের উদ্যানশোভিত বাটীকাসমূহ। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলে ঢাকা শহর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ঝিমিয়ে পড়ে। সেই সুষুপ্তি থেকে আবার সে জেগে ওঠে রমনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর। পরিত্যক্ত সেক্রেটারিয়েটে বসে কলাভবনের ক্লাস, কার্জন হল সংলগ্ন ইমারতসমূহে বিজ্ঞান বিভাগ। ছড়ানো-ছিটানো রাজপুরুষদের বাড়িগুলোয় থাকতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। সবুজ রমনার বুকে শান্তশ্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ক্যাম্পাস আজ নেই: ছাত্রসংখ্যা ও অন্যান্য চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন তিল ঠাঁই আর নাহি রে। কিন্তু সেই বিশের দশকের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্থির চিত্র আজো অমলিন বেঁচে আছে বুদ্ধদেব বসুর আত্মস্মৃতিমূলক রচনায়, বিশেষত তাঁর আমার যৌবন-এ। সে-চিত্র স্মৃতিমেদুর ও মনোহর; ইংরেজিতে যাকে বলে idyllic। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো রমনা ও পুরানাপল্টন এলাকার যেসব বর্ণনা আছে তাঁর লেখায়, তার একটি archival value-ও রয়েছে। অসামান্য সেইসব বর্ণনা পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। পুরানা পল্টনের হিমকুয়াশাঘেরা মাঠের ভেতর টিনের বাড়ি, মেঠো পথ এখন মাথা খুঁড়েও ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ল্যান্ডমার্কগুলো এখনো আছে। আমি বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বসু-র উদ্ধৃতি দিই। “ভেতরে বাইরে জমকালো এক ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয। নিখিলবাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরা-কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ-বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস: আছে ব্যায়ামাগার ও ক্রীড়াঙ্গন ও জলক্রীড়ার জন্য পুস্করণী — যেখানে-সেখানে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ। ইংলন্ডদেশীয় পল্লী-নিবাসের মতো ঢালু ছাদের এক-একটি দোতলা বাড়ি — নয়নহরণ, বাগানসম্পন্ন: সেখানে কর্মস্থলের অতি সন্নিকটে বাস করেন আমাদের প্রধান অধ্যাপকেরা: অন্যদের জন্যেও নীলখেতে ব্যবস্থা অতি সুন্দর। স্থাপত্যে কোনো একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়া দিল্লীর জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি। বিজ্ঞানভবনগুলি আরক্তিম ও তুর্কি শৈলীতে জাফরিখচিত, মিনারশোভন…।” আজকের যানজটকণ্টকিত নীলখেত মোড়ের কথা ভাবুন পাঠক। বুদ্ধদেবের সময় এর পরেই ছিল আদিগন্ত ধানক্ষেত, বহুদূরে সূর্য অস্ত যেত; নীলখেতের, মূলত ঢাকা শহরের, প্রান্তসীমা চিহ্নিত করে ছুটে যেতো রেললাইন। বুদ্ধদেব বসু-র বর্ণনায় নীলক্ষেতকে আজ মনে হবে রোমান্টিকতায়-নীল নিসর্গের মতো: “অচিরসমাপ্ত একটি পথ — একদিকে খানপাঁচ-সাত অধ্যাপক নিবাস, অন্যদিকে আদৃষ্টিসীমা প্রান্তর — শূন্য জমি, ঘাসের জমি, ধানখেত হয়তো, আর দূরে একখানা মস্ত গোল অবাধ আকাশ মাটির বুকে লুটিয়ে পড়েছে। বাড়িগুলো একতলা ও অনুচ্চ বলে ভূদৃশ্য ব্যাহত হয়নি; আর এই প্রাকৃত শোভাকে সুন্দরতর করে তীব্র একটা বাঁক নিয়ে চলে গেছে মৈমনসিংহের দিকে রেললাইন।” নীলখেতের ঐ অধ্যাপকনিবাসগুলোর কয়েকটি আশির দশক পর্যন্ত অটুট ছিলো: সেইসব একতলা ভবনের একটিতে, আমার সমকালীন ও কিঞ্চিত্তরুণতরদের মনে পড়বে, আবু সাঈদ হল নামে একটি অননুমোদিত ছাত্রাবাস গড়ে উঠেছিলো স্বাধীনতার পর-পর। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সুশোভন সরকার এবং বাংলার অধ্যাপক কবি মোহিতলাল মজুমদারের নীলখেত-আবাসে যাতায়াত ছিল বুদ্ধদেবের। আশির দশকে আধুনিক বহুতল শিক্ষকনিবাস শহীদ গিয়াসউদ্দিন এলাকা গড়ে তোলার সময় বুলডোজোরের শিকার হয় সেইসব বাড়ি।

কেমন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চেহারা সেসময়? বুদ্ধদেব লিখছেন: “আক্ষরিক অর্থে আবাসিক নয়, কিন্তু গড়ন কিছুটা সেই ধরনের: যে-সব ছাত্র স্বগৃহবাসী তাদেরও সংলগ্ন থাকতে হয় কোনো-না-কোনো ‘হল’ অথবা হস্টেলে — তাদের প্রাচীরাতিরিক্ত ক্রিয়াকর্মের সেটাই হলো ঘটনাস্থল। সেখানে আছে আলাদা-আলাদা গ্রন্থাগার ও রঙ্গালয় ও নানান ধরনের খেলার ব্যবস্থা; অনুষ্ঠিত হয় বিতর্কসভা, সংগীত-প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ভোজ, ও আরো অনেক সময়োচিত অধিবেশন : সেখানকার নাট্যাভিনয় দেখতে নগরবাসীরাও সোৎসাহে সমবেত হন। ক্লাশ ফুরোনোমাত্র কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক চুকলো, এমন এখানে হতেই পারে না — কেননা প্রায়ই আমাদের ফিরে আসতে হয় কোনো-না-কোনো সান্ধ্য অনুষ্ঠানে — মনোজ্ঞ না হোক অন্ততপক্ষে কৌতূহলজনক।” ঢাকার সাংস্কৃতিক জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কেন্দ্রীয় গুরুত্ব, হায়, বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। হলগুলোতে আর আগের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতে দেখা যায় না। কেন্দ্রীয়ভাবেও যা আয়োজিত হয় তা দায়সারা ও নিয়মরক্ষার আয়োজনমাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো দিনের এইসব বর্ণনা আমাদের মনকে কিছুটা হলেও বিষাদাক্রান্ত করে।

বুদ্ধদেব বসু তাঁর আমার যৌবন-এ ছাত্রসংসদ নির্বাচনের বর্ণনাও দিয়েছেন, জানিয়েছেন কীভাবে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, তাঁকে সাহিত্যসম্পাদক পদে নির্বাচন করতে হয়েছিলো। নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি, এবং সেই সুবাদে তাঁর চেষ্টায় “জগন্নাথ হল্-এর বার্ষিক পত্রিকা বাসন্তিকার কিছুটা হয়তো শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিলো সে-বছর।” এই জগন্নাথ হলেই প্রথম তিনি দেখেন নজরুল ইসলামকে এবং “অন্য অসংখ্যের মতোই দেখামাত্র প্রেমে” পড়েন তাঁর। নজরুলের জন্য বুদ্ধদেব জগন্নাথ হলে একটি সভা আহ্বান করেছিলেন, “তাতে ভিড় জমেছিলো প্রচুর, দূর শহর থেকে ইডেন কলেজের অধ্যাপিকারাও এসেছিলেন, তাঁর গান ও কবিতা-আবৃত্তি শুনে সকলেই মুগ্ধ: মৃত অথবা বৃদ্ধ অথবা প্রতিষ্ঠানীভূত না-হওয়া পর্যন্ত কবিদের বিষয়ে যাঁরা স্বাস্থ্যকরভাবে সন্দিগ্ধ, সেইসব প্রাজ্ঞদেরও মানতে হয়েছিলো যে ‘লোকটির মধ্যে কিছু আছে’।” পরে এক অধ্যাপকের বাড়িতে নজরুলের গান-রচনার প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনাও দিয়েছেন বুদ্ধদেব: কোন ডকুমেন্টারি ছবিও এতটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতো না সৃষ্টিসুখের উল্লাসে উদ্দীপিত নজরুলের সেই মনোহরণ দৃশ্য: “যেমন তাঁর গান গাওয়া নিষ্কুণ্ঠ তেমনি তাঁর রচনাও এক প্রকাশ্য ঘটনা: … সামনে হার্মোনিয়ম, পাশে পানের কৌটো, হার্মোনিয়মের ঢাকনার উপরে খোলা থাকে তাঁর খাতা আর ফাউন্টেনপেন — তিনি বাজাতে-বাজাতে গেয়ে উঠলেন একটি লাইন, তাঁর বড়ো-বড়ো সুগোল অক্ষরে লিখে রাখলেন খাতায়, আবার কিছুক্ষণ বাজনা শুধু — দ্বিতীয় লাইন — তৃতীয় — চতুর্থ — দর্শকদের নীরব অথবা সরব প্রশংসায় চর্চিত হয়ে ফিরে-ফিরে গাইলেন সেই সদ্যরচিত স্তবকটি: এমনি করে, হয়তো আধ ঘণ্টার মধ্যে, ‘নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরান-পিয়া’ গানটি রচনা করতে আমি তাঁকে দেখেছিলাম — দৃশ্যটি আমার দেবভোগ্য মনে হয়েছিলো।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সুখস্মৃতি ছড়িয়ে আছে বুদ্ধদেব বসুর লেখায। আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাশমহলে নানা মনোরঞ্জনী উপচারের বর্ণনা। তার মধ্যে আছে ছাত্রদের কমনরুম, যেখানে “সারি-সারি আরাম-কেদারা সাজানো, টেবিলে-টেবিলে ছড়িয়ে আছে সব সম্ভ্রান্ত বাংলা মাসিক ও ‘পাঞ্চ’ থেকে ‘রিভিয়ু অব রিভিয়ুজ’ পর্যন্ত রং-বেরঙের লণ্ডনি চালান।” আর ছিল আদিত্যর টিনের চালঅলা দর্মার ঘরে চায়ের দোকান, মনে হয় পরবর্তীকালের বিখ্যাত মধুর কেন্টিনের পূর্বসূরী সেই স্থান যেখানে ছাত্ররা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করে, আর “স্থূলবপু গুম্ফবান সুস্নিগ্ধ একটি মানুষ, আদিত্য”, ছাত্রদের কাছে প্রিয় আদিত্য-দা, “যার খাবারের দাম দেবার জন্যে পকেট হাতড়ানোর দরকার নেই, ‘লিখে রেখো’ বলাই যথেষ্ট।” কী চমৎকার মিলে যায় এই ছবিটি আমাদের চেনা, একাত্তরের শহিদ, মধুসূদন দে-র সঙ্গে। সেই বিখ্যাত মধু-দা বুদ্ধদেব বসু-র আদিত্য-দার অধঃস্তন পুরুষ কিনা তা আমার জানা নেই।

বুদ্ধদেবের মুগ্ধ স্মৃতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো সেকালের ছাত্রীদের সম্পর্কে বর্ণনা। “একমুঠো ছাত্রীও আছেন আমাদের সঙ্গে — আছেন, এবং অনেক বিষয়ে নেই। যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, পৃথক্কৃত ও সুরক্ষিত এক অতি সুকুমার উপবংশ, তাঁরা অবকাশের প্রতিটি মিনিট যাপন করেন তাঁদের পদায়িত বিশ্রাম-কক্ষে, অধ্যাপকদের নেতৃত্বে ছাড়া সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হন না। প্রতি ঘণ্টার শুরুতে এবং শেষে করিডোরগুলি বিভিন্নমুখী মিছিলে ভরে যায়: মহিলাগুচ্ছকে পশ্চাদ্বর্তী করে চলেছেন এক-একজন অধ্যাপক, পুনশ্চ নির্বিঘ্নে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের কমনরুমের দোরগোড়া পর্যন্ত। ক্লাশে তাঁদের জন্য বসার ব্যবস্থা আলাদা, আমাদের বেঞ্চিগুলো থেকে দূরে বসানো চেয়ারে: সেখানে তাঁরা চক্ষু নত রাখেন পুঁথির ওপর, কোনো প্রশ্ন করেন না অধ্যাপককে, পাঠ্যবিষয়ে হাসির কথা থাকলেও তাঁদের গাম্ভীর্যে টোল পড়ে না।” আজকের দিনে এসব কথা অবিশ্বাস্য মনে হবে, তবে আমার নিজের ছাত্রজীবনেও, একাত্তরের আগপর্যন্ত, ছাত্রীরা পৃথক বেঞ্চে বসতো; তবে অধ্যাপকদের পশ্চাদ্বর্তীনী হয়ে প্রবেশ-প্রস্থানের পশ্চাৎপদতা বোধ হয় পঞ্চাশের দশকেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বুদ্ধদেবের সময়ও ছেলে-মেয়েতে কথাবার্তা আদৌ হতো না তা নয়: দুয়েকজন ডাকাবুকো ছেলে লেডিজ কমনরুমের বেয়ারার হাতে চিরকুট পাঠিয়ে কোনো বাসন্তী সেন বা অমিতা চন্দর সঙ্গে দু-চার মিনিট অর্থহীন কথা সেরে নিতেই পারতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিকালের রূপকথার আরেকটি দৃশ্য ভেসে ওঠে আমাদের মনশ্চক্ষে: বই-খাতা হাতে বিংশতিবর্ষীয় যুবক বুদ্ধদেব চলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, পুরানা পল্টনের সেই টিনের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে, একটি রাস্তায় “যা চলে গেছে পুরানা পল্টনের মোড় থেকে পশ্চিমদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বার পর্যন্ত এক মাইল।” পাঁচ মিনিট পর মেয়েদের হস্টেল, রমনার সব সুন্দরের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সেই চামেলী হাউস থেকে বেরিয়ে এলো পাঁচটি অথবা সাতটি সহপাঠিনী। চলার গতি শ্লথ করলেন বুদ্ধদেব, যাতে অন্তত পেছন থেকে তাদের নিরীক্ষণ করা যায়। “সৈনিক অথবা খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীদের মতো শ্রেণীবদ্ধ হয়ে হাঁটছেন তাঁরা, সমতলে পা ফেলে-ফেলে — মাথা আঁচলে ঢাকা, চওড়া-পাড়ের শাদা শাড়ি পরনে, যৌবনসুলভ চাঞ্চল্যের কোনো লক্ষণ নেই, আর পা-ফেলা এমন ঢিমে লয়ের যে একটু পরেই তাঁদের অতিক্রম না করে আমার উপায় থাকে না।” আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচঞ্চল, লঘুপদবিক্ষেপে-প্রায়-নৃত্যপরা, বিদ্যার্থিনীদের দেখলে কে ভাববে একদা তাদের প্রপিতামহীরা এই বিদ্যাপিঠে কীরকম কুণ্ঠিত অস্তিত্ব ধারণ করতেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সব স্থিরছবি চিরকালের মতো সবুজ ও হৃদ্য হয়ে থাকবে বুদ্ধদেব বসু-র স্মৃতিকথায়। তাঁর জন্মবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃতী সন্তানকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবো।

লেখকঃ খোন্দকার আশরাফ হোসেন | ২৮ নভেম্বর ২০০৮
chairengdu@yahoo.com